অতীতকে ফিরে দেখা - দৈনিকশিক্ষা

অতীতকে ফিরে দেখা

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

ইতোমধ্যে বয়সে আমি ষাটের কোঠায় পা দিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারি কোনো কোনো রাতে আমার ঘুম সহজে আসে না। বিছানায় গেলে এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ভাবনা মাথায় এসে জট পাকায়। মাঝে মাঝে মনের ঘড়ির কাঁটা চলে যায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পেছনে স্মৃতি রোমন্থন করতে। আমি তখন দশ-বারো বছরের বালক - শুয়ে আছি আমাদের গ্রামের বাড়ির বাঁশের বেড়া আর কাঁচা মেঝের চারচালা টিনের ঘরের একটি ছোট্ট কামরায় শক্তকাঠের চকিতে। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে বেড়াত, ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যেত বাইরের যাবতীয় চেচামেচির আওয়াজ। আমাদের ঘরের পেছন দিয়ে গ্রামের লোকজনের চলাচলের জন্য একটি সরু আঁকা বাঁকা মেঠো পথ ছিল। ওই পথ ধরে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাটবাজার শেষে দলে দলে গল্প বলতে বলতে ঘরের পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামের লোকজন বাড়ি ফিরতো। কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা না গেলেও ঘরের ভেতরে আমার কানে ভেসে আসতো অনর্গল মানুষজনের গুঞ্জন আর তাঁদের পায়ের আওয়াজ। যারা দেরি করে গভীর রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতো তারা ভূতের ভয় তাড়াবার জন্য জোর গলায় গান গেয়ে গেয়ে চলতো। ততক্ষণে আমার দু’ এক চক্র ঘুম পুরো হয়ে যেত। ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পেতাম পথচারিরা হাঁটছে আর সুর করে চড়া গলায় গাইছে-নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা.., চুমকি চলেছে একা পথে সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে...., রুপে আমার আগুন জ্বলে-যৌবন ভরা অঙ্গে......, নীল আকাশের নীচে আমি...... এমনি নানান ধর্মী গান শুনতে শুনতে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম বুঝতেও পারতাম না।

বর্ষাকালে গ্রামের খাল-বিল পানিতে হয়ে উঠে টইটুম্বুর। মাঝি নাও বাইতে বাইতে ভাটিয়ালী সুরে এমন গান গায়। পেছন ফিরে যখন ভাবি, শীতকালে কৃষকের গলায় কেন গরম কালের গান? সে প্রশ্ন কাউকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করাও হয়নি। কৌতূহলী মনকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছি এভাবে, হয়তোবা তারা অন্য কোনো গান জানত না। হয়তোবা ভাটিয়ালী গানের আবেদন গ্রাম্য কৃষকের জীবনে সময় কিংবা ঋতুর বন্ধনে বাঁধা পড়ে থাকতে চাইত না। আমি নিজেও মাঝে মধ্যে চার দেয়ালের ভিতর গোসলখানায় বেখেয়ালীভাবে এলোমেলো গান গাই। কখনো ভাবি না গোসল বা গোসলখানার পরিবেশের সঙ্গে গানের পঙক্তিগুলো কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
 
চল্লিশ বছরেরও অধিক কাল পড়ালেখা ও চাকুরির সুবাদে ঢাকায় থাকি। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যাই। কখনো পারিবারিক কাজে, কখনো সাংসারিক কাজে, আবার কখনো ছুটি কাটাতে বিনোদনে। গ্রামের বাড়িতে গেলেও সময়ের অভাবে বেশিদিন থাকা হয় না। গ্রামের বাড়িতে ওই ঘরের অবস্থার অনেক উন্নতি হলেও সেখানে ঘুমোবার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। উপজেলা সদরে নিকট আত্মীয়দের বাড়ি থাকায় সেখানেই থাকা হয় বেশির ভাগ সময়। আমার গ্রামের বাড়িতে আমি ছোটবেলায় বন্ধুদের নিয়ে যে যে কর্মকাণ্ড করে বেড়াতাম যেমন - মার্বেল খেলা, কইট খেলা, গোল্লাছুট, দাড়িয়া বাঁধা, হা-ডু-ডু, ষোলগুটি, লুডু খেলা, নৌকা বাইচ, সাঁতার প্রতিযোগিতা, উচু গাছের ডাল বা ব্রিজ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়া; ভোর বেলায় ফজর নামাজের পর পর চাচাতো-ফুফাতো-খালাতো-মামাতো ভাইদের মধ্যে কে কার আগে আম, জাম, লিচু, গাব গাছে উঠে পাকা ফল খেতে পারবে;  আবার দুপুর বেলায় কাউ ফল, বাতাবি লেবু, শরিফা ফল, ঢেউয়া ফল, পেয়ারা, ডাব-নারিকেল প্রভৃতি গাছে উঠে পেট ফল খেয়ে গাছ থেকে নেমে আসতে পারা ইত্যাদি সংস্কৃতি আজও বিরাজ করছে কি না? প্রায়শই আমার জানতে ইচ্ছে করে। সেই সংস্কৃতি থেকে থাকলে বর্তমান প্রজম্ম কীভাবে তা উপভোগ করছে? সেই মেঠো পথের অবস্থা কী রকম হয়েছে? এখনো কি বাজার ফেরা লোকজন সে পথ ধরে গভীর রাতে গান গেয়ে গেয়ে বাড়ি ফিরে কি না? এ প্রশ্নগুলো যখন তখন মনে উঁকি মারে। জিজ্ঞেস করার মতো হাতের কাছে কাউকে খুঁজে পাই না। আপন মনের জওয়াব নিজে খুঁজতে গিয়ে ভাবি – হয়তোবা এখন আর বাজার ফেরত লোকজনের ওইভাবে জোরে জোরে গান গেয়ে বাড়ি ফেরার দরকার পড়ে না। কারণ ওইসব জায়গায় এখন আর রাতের বেলা অন্ধকার থাকে না। পল্লী বিদ্যুতের বদৌলতে ওই রাস্তায় এখন সারারাত আলো ঝলমল করে। আগে যেমন ওখানে অন্ধকারে একদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকার মেলা বসতো এবং ভূতের ভয়ে গা ছমছম করতো। সেই আমাদের ছোট্ট ঘরের পেছনের রাস্তার ওপরে এখন ফকফকা বিদ্যুৎ বাতির আলোয় চারদিকে গিজগিজ করে হাজার জাতের কীটপতঙ্গ। ওড়াউড়ি করা হরেক রকমের পোকা-মাকড় খাওয়ার জন্য পাখিরা ভীড় জমায়। এমন পরিবেশে মানুষের মনে এখন আর জ্বিনভূতের ভয় নেই, আলোর ভয়ে ভূতেরাই এখন পালিয়েছে গ্রাম ছেড়ে অজানা কোনো গন্তব্যে।

ছোটবেলায় দেখেছি, আমার বাড়ির এক চাচি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তো, জিজ্ঞাসা করলে শুনতাম ওনাকে জ্বীনে ধরেছে। সুতরাং জ্বীন তাড়াতে হবে! তুলা রাশিওয়ালা লোক খুঁজে এনে তার হাতে বড় দা দেয়া হতো, সে দা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রচণ্ড বেগে বড় গাছে কোপ দিয়ে জ্বীনকে বন্দি করতো। কখনো বা শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে রোগীর নাকে দিয়ে বলা হতো তুই যাবি কিনা বল! না হয় বোতলে পুরে রাখব! কোনো বাড়িতে কিছু চুরি গেলে বাটি চালা বা আয়না পড়া বা চাউল পড়া দিয়ে চোর ধরার জন্য অনেক টাকা ব্যয় করা হতো ইত্যাদি। এসব কুসংস্কার বর্তমানে কতটা পরিমাণে প্রচলিত আছে জানি না! থেকে থাকলে কখন এসবের শেষ হবে তা ও জানি না। যদি কিছুটা পরিমাণে কমেও থাকে তাহলে কি কারণে কমেছে জানি না। আমার মনে হয় শিক্ষার সম্প্রসারণ ও সংস্কৃতির পরিবর্ধনের কারণেই কিছুটা কমেছে।
 
আগে বন্ধুরা একসাথে খেলতাম, নানা বিষয়ে সিদ্বান্ত নিতাম, গুরুজনদের নির্দেশনায় নানা রকম সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতাম, আর এখন মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার গেমস, ফেসবুক, টিভি ইত্যাদি নিয়ে ছেলে-মেয়েরা একাকী শিখতে ও বিনোদন করতে পছন্দ করে বেশি। ফলে তারা হয়ে যাচ্ছে অনেকটা স্বার্থপর। পর্যায়ক্রমে মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে, বাবা মা দুজনেই এখন জড়িয়ে পড়ছে রাজনীতিসহ অন্যান্য কার্যক্রমে, ফলশ্রুতিতে বাচ্চারা অনেকটা জবাবদিহিতার বাহিরে চলে যাচ্ছে, হয়ে পড়ছে একাকী, আবার কখনো ভুল পথে পরিচালিত হয়ে জঙ্গিবাদ, মাদকাসক্তসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিচ্ছে। সামাজিক রীতি-নীতি অতটা আমলে নিতে চাচ্ছে না। পারিবারিক বন্ধন ও অনেকটা শীথিল হয়ে আসছে। সিনিয়র সিটিজেনরা উৎকণ্ঠার মধ্যে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন, ক্রম-উন্নয়ন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্র, যোগাযোগ ও অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ সৃষ্টির কারণে সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে।

সে যা হউক আমাদের গ্রামের সেকালের ঘরগুলো এখন আর চোখে পড়ে না, সেখানে গড়ে উঠেছে পাকা দালান-কোঠা। এতে অন্য সবাই খুশি হলেও আমি ততটা খুশি হতে পারছি না। দালান কোঠায় ফাঁক-ফোকর নেই, দরজা জানালা বন্ধ করলে সে ঘরে আর আলো-বাতাস ঢোকে না। বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে, তাই নতুন দালান ঘরে ফ্যান চলে, বাতি জ্বলে। এর মধ্যে অনেক ঘরে ফ্রিজ ও এসি লাগানো হয়ে গেছে। ঘরের বাহিরে গিয়ে ওয়াজ মাহফিল বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করেও ইউটিউবের বদৌলতে তা ঘরে বসে উপভোগ করা যায়। মজবুত দালান ঘরের সুবিধাটা ছোট বড় সবাই বুঝে, এমনকি বাড়ির কাজের লোকটি পর্যন্ত। পাকা ইমারত গরমকালে টিনের ঘরের মতো গরম হয় না এবং শীতকালে তেমন ঠাণ্ডা অনুভুত হয় না। বা! কী মজা! মজা যতই হোক না কেন, আমার আফসোসটা অন্যখানে। সুবিধাটা যত সহজেই পাওয়া যাক না কেন, অসুবিধাটা কারো চোখেই ধরা পড়ে না, কারো হৃদয় এতটুকু স্পর্শ করেছে বলেও মনে হয় না। শীতকালে দালান ঘরে চারদিক থেকে যেমন নির্মল কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে ঢুকে না, তেমনি পেছনের রাস্তা থেকে ভেসে আসে না অজানা অচেনা বাজার ফেরত গ্রাম্য কৃষক-কণ্ঠের সুমিষ্ঠ ভাটিয়ালী গানের সুর, যে সুরের মূর্ছনায় ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের ওই কাঁচা ঘরের শক্ত বিছানায় কাঁথার নিচে আমি বড় আরামের ঘুম ঘুমাতাম! স্কুল থেকে ফিরে সতেজ ফলমূল খেতাম। আধুনিকতা এবং বৈষয়িক উন্নয়ন আমাদের দিয়েছে অনেক, আবার যা নিয়েছে, তাও কম নয়! যা দিয়েছে, তা টাকার অঙ্কে হিসেব করা যায়, কিন্তু যা নিয়েছে, তার কোনো পরিমাপ হয় না! হয় কি? সম্মানিত পাঠকরা বলতে পারবেন কি?

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন : পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045008659362793