অথঃ ভিসিনামা - দৈনিকশিক্ষা

অথঃ ভিসিনামা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ভাইস চ্যান্সেলর বিদেশি শব্দ। বিভিন্ন দেশে শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় ব্যবহৃত হয়। কোথাও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চ্যান্সেলর বলা হয়, কোথাও আবার বিচারালয়ের প্রধান হিসেবে। ব্রিটিশরা তাদের অধিকৃত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেখভালের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের ভাইস চ্যান্সেলর বলত। তার অর্থ নিয়োজিত ব্যক্তি সর্বময় প্রধান নয়। প্রধানের আজ্ঞাবহ। আমাদের দেশে শব্দটির বাংলা তরজমা করা হয়েছে আচার্য শব্দের আগে উপসর্গ সন্নিবেশ করে। যার প্রকৃত অর্থ আচার্যের হয়ে কাজ করা। আর আচার্য শব্দের আভিধানিক অর্থ শিক্ষাগুরু, বেদের অধ্যাপক ইত্যাদি। যেমন—দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। রোববার (১ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমাদের দেশে উপাচার্য অপেক্ষা ভাইস চ্যান্সেলর শব্দটি বহুল পরিচিত। এ যেন বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। শব্দটি এখন সংক্ষেপিত করে বলা হচ্ছে ভিসি। অভিধাটি গত শতকে অত্যন্ত মর্যাদার ছিল।

৫০ বছরেরও আগে আমরা দেখেছি, ব্যতিক্রম ছাড়া সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। জ্ঞান-গরিমায় অধিকতর উজ্জ্বল ব্যক্তি ভিসি পদে অভিষিক্ত হতেন। তাঁরা রাজনৈতিক চেতনায় কিংবা মতবাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে যা ধারণ করতেন, তা নিজের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য নিজেকে জাহির করতেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি প্রকাশ্যে দলীয় কিংবা মতবাদী হিসেবে পরিচিত হন, তবে সেই দল কিংবা মতবাদের অনুসারীরা তাঁকে নিজেদের ভাববেন। অন্য মতাবলম্বীরা কারণে-অকারণে তার সমালোচনায় রত হবেন এবং অতি সাধারণ ত্রুটি তুলে ধরে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করবেন। এতে ছাত্রসমাজ সংক্রমিত হয়ে পড়ে, কারণ বর্তমানে শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো দল বা মতবাদে বিশ্বাসী।

শতভাগ কেউ নিরপেক্ষ হতে পারেন না বা সবার কাছে মনঃপূত না-ও হতে পারেন। তাই বলে ক্ষমতার কাঁধে সওয়ার হয়ে নিজেকে জাহির করা নয়। এটা রাজনীতির কাজ, শিক্ষাদানের নয়। এখন ক্ষমতার বলয়ে থেকে ওপরে ওঠার জন্য প্রকাশ্যে নামাবলি পরেন। তাইতো লাল-নীল-সাদা-হলুদের সমারোহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতির অখড়ায় পরিণত। ফলে পদপ্রাপ্তির জন্য আদর্শে বিশ্বাসী না হয়েও অনেকে নতজানু। শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ না বুঝে উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য ক্ষমতার পতাকাতলে সমবেত হয়। ভাবে, যদি কিছু প্রসাদ মেলে। তাই জ্ঞানার্জনের প্রাসাদ যেন প্রসাদ বিতরণের মন্দির।

জাতীয় ট্র্যাজেডির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হ-য-ব-র-ল অবস্থায় চলেছে। চর দখলের মতো রাতের অন্ধকারে ক্ষমতার অনুকম্পাপ্রাপ্তরা ভিসির পদ দখল করেছেন। আবার একসময়ের ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য ভিসির পদে আসীন হয়েছেন। অথচ সম্মিলিত ছাত্ররা ‘বাড়িত যা’ বলে তাঁর পিছু ধাওয়া করেছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সময়।

কিছুদিন থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিকে কেন্দ্র করে অশান্তি বিরাজ করছে। জ্ঞানের অন্যতম বাহন যে সহিষ্ণুতা তা কোনো পক্ষই অনুশীলন করে না। এর অন্যতম কারণ জ্ঞান নয়, অনৈতিক সুবিধা কবজায় আনা।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন জ্ঞানকে গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখার অভিপ্রায়ে। হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রম ছাড়া, মেধাবী হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিরা সাদরে আমন্ত্রিত হতেন। তাঁরা বেশির ভাগই নিরাসক্তভাবে জ্ঞান বিতরণে সম্পৃক্ত থাকতেন। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁদেরই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের ভার দিয়েছিলেন। এখন বিচিত্র অলিগলি দিয়ে তথাকথিত দলীয় ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনাগোনা। জ্ঞানের প্রতি তাদের আগ্রহ কম। দলবাজি করে নেতার প্রতি কৃত্রিম শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠেন। সত্তা বিক্রি করে ক্ষমতায় বসে তাঁরা জ্ঞান আর জাতীয় পরিচিতির কথা ভুলে যান। সন্তান-সন্ততি আর চাটুকারদের পদায়ন ও প্রসাদ বিতরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকের অসন্তোষের অন্যতম কারণ এটি। তা ছাড়া পথ আর অর্থের প্রতি মোহ তো আছেই।

পদলোভীরা জানেন, ওই পদটি সাধারণ মানুষের কাছে এখন অনেকটা খেলো। তাহলে কী! এ যে অনায়াস প্রাপ্তির মতো! তা ছাড়া আরব্য উপন্যাসের আবু হোসেনের, একদিনের হলেও বাদশার খায়েশ আছে না!

আজকের দিনে ভিসি সংখ্যার আধিক্যে তাঁরা জনস্রোতে হারিয়ে যান। অথচ অর্ধশতাব্দীকাল আগেও ভাইস চ্যান্সেলর অভিধাটি উচ্চারিত হলে মানুষ নড়েচড়ে বসতেন। এখন ঘাড়ের ওপর দিয়ে গেলেও কেউ কৌতূহলী হন না। এতদসত্ত্বেও পদলোভীরা কামড়াকামড়িতে ব্যস্ত। এঁরা স্তাবকতাকে পুঁজি করে দলবাজির শিখরে পৌঁছে পদ বাগিয়ে নেন। তারপর জ্ঞান নয়, আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিষয়গুলো অন্ধও দেখতে পায়। ফলে পরস্পর-বিরোধিতা শুরু হয়। যোগ্যতাহীন যাঁরা দলবাজি, আত্মীয়তা ও স্তাবকতার সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারভুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরাও সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন।

শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নত দেশে ভিসি নিয়ে কেউ নাক গলায় না। যেখানে যথাযথ ব্যক্তি জ্ঞানানুশীলন এবং সংশ্লিষ্টদের সুশৃঙ্খল পরিচালনায় রত থাকেন। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখেন না। বিশ্ববিদ্যালয় চরদখলের জায়গা নয়। জ্ঞান প্রজ্বালনের নিভৃত অঙ্গন। এর পরিবেশ মেধাহীনদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে কলুষিত হলে ইংরেজি ‘ভাইস’ শব্দের একটি বিশেষ অর্থের দৌরাত্ম্যে জ্ঞানাঙ্গন রণাঙ্গনে পরিণত হয়।

মহাকবি ফেরদৌসী রচনা করেছিলেন ‘শাহনামা’ মহাকাব্য। লেখা বাহুল্য নামা শব্দটি ফারসি। এর নানা অর্থের মধ্যে ইতিহাস অন্যতম। ফেরদৌসী প্রাচীন পাহলবি বংশের রাজন্যবর্গের কালপরম্পরা লিপিবদ্ধ করেন শাহনামায়। ভারতে একদা লেখা হয়েছিল বাবরনামা! বাংলাদেশে দোভাষী পুঁথির যুগে রচিত হয়েছে ‘জঙ্গনামা’, সিকান্দারনামা’। গত শতক পর্যন্ত তার সিলসিলা জারি ছিল বলে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘চিত্তনামা’। একালের প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে সংযোজন করলেন ‘খোয়াবনামা’র মতো অনন্য উপন্যাস। আমরা আজকের দিনের কিছু ভিসির কর্মকাণ্ড ‘দেখিয়া-শুনিয়া’ অতি সংক্ষেপে ভিসিনামায় বিবৃত করলাম। অতিকথন হয়ে থাকলে বিজ্ঞ পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় দোষ কী?

লেখক : গোলাম কবির, সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003695011138916