কলেজ অধ্যক্ষর মাসিক ভাতা ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা! সে হিসেবে তার বার্ষিক আয় ২ হাজার ১৫২ টাকা। তা-ও উত্তোলন করতে হয় বিলের মাধ্যমে এক বছর পর একত্রে। নেই কোনো বেতন। যা পান তা মহার্ঘ ভাতা! এক একটি কলেজে ৩ জন শিক্ষক ও একজন দপ্তরি রয়েছেন। তারা চারজন মিলে এক বছরে পান ৭ হাজার ৩৪০ টাকা। দেশের সংস্কৃত ও পালি কলেজগুলোর শিক্ষকদের জীবন চলছে এভাবেই।
অবৈতনিক এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান ধর্মীয় শিক্ষক হিসাবে। এছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা এখান থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রী গ্রহণ করলেও দেশের সংস্কৃত কলেজগুলোর অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্য শিক্ষক ও কর্মচারীদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাকাই গ্রামে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ’। কলেজটির অধ্যক্ষ সত্তোরোর্ধ্ব নিখিল রায় চৌধুরী বলেন, ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত পন্ডিত হরি গোবিন্দ রায় চৌধুরী নিজের ১ একর ১০ শতক জমির উপরে নিজ নামে সংস্কৃত কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যুগে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার জন্য পন্ডিত মহাশয়ের ‘টোল’ বা পাঠশালায় দিতেন। কালক্রমে ওই সকল টোল কলেজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অধ্যক্ষ জানান, হরি গোবিন্দ কলেজে বর্তমানে পড়ানো হয় কাব্য, ব্যকরণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, পুরাণ, পুরোহিত্য ও স্মৃতি শাস্ত্রসহ ছয়টি বিষয়ে। প্রত্যেক বিষয়ে তিন বছর মেয়াদী শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করতে হয়। এসব পড়ে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন অনেকে। পাশাপাশি সামাজিক, সাস্কৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করে সম্মানসূচক ডিগ্রি গ্রহণ করেন অনেক পেশার লোকজন। যাদের নামের পূর্বে যুক্ত করা হয়- আচার্য, পন্ডিত, শাস্ত্রবিদ ইত্যাদি। অথচ সেই পন্ডিত আর শাস্ত্রবিদ তৈরির কারিগরদের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সমাজে চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত এই সকল কলেজের শিক্ষকরা। অর্থনৈতিক দৈন্য দশার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
জানা গেছে, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ডের আওতায় এসব কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। পালি বোর্ড ঢাকার কমলাপুরের বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থিত। এ বোর্ডের অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২২৭টি। কলেজগুলোতে অধ্যক্ষসহ তিনজন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী কর্মরত রয়েছেন।
তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর এসব শিক্ষকরা বেতন পেতেন ১১৫ টাকা। ১৯৭৭ সালে নতুন বেতন স্কেল নির্ধারণের সময় স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারিত হলেও তাদের হয়নি। ওই সময় ৩০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা আর কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ৩০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৪২ বছর পর ২০১৫ সালে শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে সরকার নির্ধারণ করে ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা। আর কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে করা হয় ৭৮ টাকা।
সংস্কৃত ও পালি কলেজ শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় জাতীয় পে-স্কেল অন্তর্ভুক্তিসহ ৫ দফা দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। তারা বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই শিক্ষকদের মাত্র ১৭৯ টাকা বেতন নেই। দেশের মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রচলিত বেতন-ভাতার ন্যায় সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদেরও সকল ক্ষেত্রে সম-অধিকার বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা। তাদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সংস্কৃততে তীর্থ ও পালিতে বিশারদ উপাধিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের স্নাতক/সমমান ঘোষণা, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডকে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ঘোষণা এবং সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শর্তহীনভাবে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদের নিয়োগ নিশ্চিতকরণ ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান জানান, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সারাদেশের এই কলেজগুলো পরিদর্শন করে সার্বিক অবস্থা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
সৌজন্যে: ইত্তেফাক