অর্ধ শতাব্দীকালের বেশি সময় ধরে দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মুসল্লির মহামিলন মেলা টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ের বিশ্ব ইজতেমার ছন্দপতন ঘটছে এবার। তাবলিগ জামাতের বিবাদমান দুই গ্রুপের মারমুখী অবস্থানের কারণে ইজতেমা অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ মাসে বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে না। কবে হবে বা আদৌ হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। সহিংসতার আশংকায় সরকার সোমবার (৭ জানুয়ারি) থেকে তাবলিগের জোড়সহ সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। দিল্লির নিজামুদ্দিনের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারী তাবলিগের অনুসারীরা আগামী ১১-১৩ জানুয়ারি টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা দেয়। পরে সাদবিরোধী দেওবন্দপন্থী আলেম ও তাবলিগের সাথীরা একই স্থানে ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি এবং ২৫ থেকে ২৭ জানুয়ারি দুই দফায় ইজতেমা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। এনিয়ে দেখা দেয় চরম উত্তেজনা। গত ১ ডিসেম্বর টঙ্গীতে তাবলিগের দুই গ্রুপে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এরপর থেকে হুমকি পাল্টা হুমকি দিয়ে আসছিল দুই গ্রুপ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গত রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাবলিগের দুই গ্রুপের মুরুবিবদের ডেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আলাদা বৈঠক করেন। বাতিল করা হয় দুই গ্রুপের বিশ্ব ইজতেমার সূচি।
পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে তাদের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ যাবে। সেখান থেকে ফিরে তারা সিদ্ধান্ত নিবেন কি করবেন।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকেই তাবলিগ বা বিশ্ব ইজতেমার সৃষ্টি। উভয়পক্ষই কিন্তু দেওবন্দকে মানে। তাই আমরাও বলেছি আপনারা যার যার মতো করে সেখানে যান। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও একটি দল সেখানে যাবে। এর পর দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেভাবেই ইজতেমা হবে। মাওলানা সাদ কান্ধলভির পক্ষের আলাদা ইজতেমা হবে কিনা সে বিষয়েও দেওবন্দের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে।
এদিকে দেওবন্দপন্থী আলেমরা বিশ্ব ইজতেমা বাস্তবায়ন ও ইজতেমায় সাদপন্থীদের হামলার বিচারের দাবিতে উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে খেলার মাঠে গতকাল সকাল ৯টায় একটি জরুরি মশওয়ারা সভার আয়োজন করেছিল। কিন্তুপ্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় তা বাতিল করা হয়।
জানা গেছে, দিল্লির নিজামুদ্দীন মারকাজ বা কেন্দ্র থেকে ১৯৪১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে প্রথম বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ১৯৬৬ সাল থেকে বড় পরিসরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে স্থানান্তরিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের মারকাজ হলো কাকরাইল মসজিদ। এই মসজিদের দখল ও আধিপত্য নিয়ে বহুদিন ধরে দুই গ্রুপের মনোমালিন্য চলে আসছে। মসজিদটির ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়েরের নেতৃত্বে টঙ্গীর ইজতেমা হয়ে আসছিল। কিন্তু নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিরুদ্ধে দেওবন্দ মাদ্রাসার শূরাবিরোধী কার্যক্রম, শূরা ভেঙে একনায়কতন্ত্র কায়েম, তাবলিগ কাঠামো পরিবর্তন ও ইসলাম নিয়ে মনগড়া বিতর্কিত বক্তব্যের অভিযোগ আনা হয়। সেই সঙ্গে ইজতেমায় তার যোগদানে বাঁধা দেয় যুবায়েরপন্থিরা। তবে অন্যপক্ষ সাদকে আনতে একাট্টা। এতে করেই বাংলাদেশে দুটি গ্রুপ সহিংসতায় লিপ্ত হয়।
তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ শাহ’র (রহ.) দৌহিত্র মাওলানা সাদ কান্ধলভী দিল্লি মারকাজের আমিরের দায়িত্ব নিয়ে ২০১৬ সালে ২৬টি বিষয়ে ফতোয়া দেন। যা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তার এসব বিতর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহার করার জন্য ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শীর্ষ আলেমদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি সম্মত হননি। এরপর তাকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন দেওবন্দপন্থীরা। সেই থেকে রক্তারক্তির শুরু। সাদ এর পক্ষের নেতৃত্বে আছেন প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। আর বিপক্ষের নেতৃত্বে আছেন হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের। তবে এদের মূল মুরুব্বি হেফাজাতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফি।
এই হামলার জন্য দায়ী করে সাদপন্থি মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, ড. কাজী এরতেজা হাসানসহ কয়েকজনের ফাঁসি চেয়ে রাজধানীতে পোস্টার সাঁটায়। যদিও ফরিদ উদ্দিন মাসউদ নিজেকে মূলধারার বলে দাবি করে আসছেন।