নতুন বছর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। শুভতার প্রত্যাশায় তাকে স্বাগত জানাতে মানুষ পথে নেমে আসে। প্রভাতের প্রথম আলোয় সংগীত সমাবেশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বরণ করে নতুন বছরকে। আজ পহেলা বৈশাখ। আজ সূর্যের নতুন আলোর সঙ্গে এসেছে নতুন বছর, বঙ্গাব্দ ১৪২৬। আজ নব আনন্দে জেগে ওঠার দিন।
বাংলাদেশ নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠান যেমন পাকিস্তান আমলে এক দ্রোহ থেকে জন্ম নিয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রাও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিবাদ জানিয়ে শুরু হয়েছিল। এরপর দেশে রাজনৈতিক নানা পটপরিবর্তন হয়েছে। তবে, এ দুটি আয়োজন সবসময় মানুষকে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার প্রত্যয় জুগিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বজনীন উত্সবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। আজ দেশজুড়ে নানা অনুষ্ঠানে গানে গানে, আনন্দ আয়োজনে নতুন বছরটিকে বরণ করে নেবে বাংলার মানুষ।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। নববর্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টি- জেপি চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।
রাজধানীতে প্রতিবছর ছায়ানটের প্রভাতি অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উদযাপন। আজ সবার ঠিকানা হয়ে উঠবে রমনা বটমূলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমি, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর এলাকা। ভোর সোয়া ছয়টায় শুরু হবে এ আয়োজন। ৫২ বছর ধরে বৈশাখে নতুন আবাহন নিয়ে হাজির হয় ছায়ানট। এ দীর্ঘপথচলা নিঃসন্দেহে জাতির জীবনে এক প্রেরণাসঞ্চারি ঘটনা। এদিকে, ইউনেস্কোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হবে সকাল নয়টায়। নতুন অঙ্গীকার ও উত্সাহের মধ্য দিয়ে পালিত হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুধু ঢাকা নয়, এখন সারাদেশেই ছায়ানটের আদলে গানের আয়োজন এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
আজ সরকারি ছুটি। বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ উদযাপনে রাজধানীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার জন্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, সেমিনার, নাটক প্রদর্শনী ও খাবার বিতরণ। বিটিভিসহ বেসরকারি টিভিতে দিনটি উদযাপনের জন্য নানা অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করা হবে। এছাড়া, ছায়ানটের প্রভাতি অনুষ্ঠান বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করবে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বিসিক নববর্ষ মেলা, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) দিনব্যাপী অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
ছায়ানট: সামাজিক সকল অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে শুভবোধ জাগিয়ে তোলার মানসে নতুন বছরকে বরণ করবে ছায়ানট। ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’ এই আহ্বান নিয়ে সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের প্রভাতী আয়োজন। তবে যথারীতি, পহেলা বৈশাখ ভোর সোয়া ছয়টায় বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে স্বাগত জানানো হবে রাগালাপ দিয়ে। ভোরে থাকছে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৃষ্টির মাহাত্ম নিয়ে ভোরের সুরে বাঁধা গানের গুচ্ছ। পরের ভাগে থাকছে অনাচারকে প্রতিহত করা এবং অশুভকে জয় করার জাগরণী সুরবাণী, গান-পাঠ-আবৃত্তিতে দেশ-মানুষ-মনুষত্বকে ভালোবাসবার প্রত্যয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা: ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’- এ প্রতিপাদ্যে এবার সকল মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতীকটি হচ্ছে পঙ্খীরাজ ঘোড়া। যার মুখটা হবে মানুষের মত। রূপকথার আশ্রয়ে তরুণদের ঊর্ধ্বপানে চাইবার এবং চলবার আহ্বান জানানো হবে এর মাধ্যমে। তরুণ প্রজন্মকে মাথা তুলে দাঁড়াবার, সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানোর প্রয়াস এ শ্লোগানে। সব বাধা পেরিয়ে অনন্ত সম্ভাবনার সামনে তরুণ প্রজন্ম। সেই কথাই তাদের সামনে তুলে ধরা। সকাল নয়টায় শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাণী
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ উত্সব সর্বজনীন ও অসামপ্রদায়িক। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং জাতিসত্তা বিকাশের শেকড়। স্বাধীনতা পূর্বকালে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি ও অসামপ্রদায়িক চেতনাবোধের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালি জাতি তা কখনো মেনে নেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসী ও প্রবাসী বাঙালিসহ সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
জাতীয় পার্টি- জেপির বৈশাখী শুভেচ্ছা
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জাতীয় পার্টি- জেপির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, এমপি এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। নেতৃদ্বয় বলেন, বাংলা নববর্ষের এই শুভক্ষণে আমরা দেশবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, আগামী বছরটি আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে এবং বিদায় নেবে দারিদ্র্য, অমঙ্গল ও পশ্চাদপদ চিন্তা। জাতির অভিযাত্রায় এই মহান লগ্নে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং বাঙালির শিল্প সংস্কৃতি ও জাতীয়তা বোধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান জানান তারা।