আবরার, ক্ষমা করো সন্তান আমার - দৈনিকশিক্ষা

আবরার, ক্ষমা করো সন্তান আমার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আবরার, বাবা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। এই লেখাটি লিখতে বসে মনে হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ—আমিও যেন আমার কাঁধে সন্তানের লাশ নিয়েই লিখছি। তুমি যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসেছিলে, এই একই স্বপ্ন নিয়ে আমিও প্রায় ২৫ বছর আগে ঢাকা এসেছিলাম। তবে তোমার মতো করে নয়, তোমার মতো অত মেধাবী আমি ছিলাম না। আমাদের এলাকাতে তোমার মতো অত মেধাবী তো আর কেউই ছিল না—কেউই নেই। তুমি আর আমি একই এলাকার সন্তান। তোমার বাবা আমার বিদ্যালয়ের বড়ো ভাই। তোমার বাড়ি আমার বাড়ি হেঁটে গেলে বড়োজোর আধা ঘণ্টার পথ। বড়ো ভাই হিসেবে তোমার বাবা আমাদের মান্য ছিলেন—আদর্শ ছিলেন। তুমি একটি আদর্শ পরিবারের সন্তান হয়ে দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র হয়ে ঢাকায় এসেছিলে—দেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলে। আমাদের আর কেউ তো এমন সাফল্যেও পথে পা রাখতে পারেনি। যা শুধু তুমিই পেরেছিলে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে—তোমার মতো করে—তোমার মতো অত মেধাবী আর কেউ আমাদের এলাকা থেকে ঢাকায় পড়তে আসেনি। আমরা যা পারিনি—তুমি তা পেরেছিলে। কিন্তু এই পারাটাকে কেন এভাবে হত্যা হতে হলো। পেশাগতভাবে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি—যদি বলি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের কাছে নিজের গ্লানি হচ্ছে—আমাদের চোখের সামনে আমাদের সোনার টুকরো সন্তানেরা হত্যা হচ্ছে—দেশের স্বপ্নের কবর রচনা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ নয়? এ তো ঘরের ছেলের নিজের ঘরে অনিরাপদ জীবন। আবরার, বাবা, আমি নিশ্চিত তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলে, তুমি বলতে চাচা, তুমি কেমন আছ? বাসায় সবাই কেমন আছে? তোমার বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে? আহা! আমার সন্তান—এভাবে কেন তোমাকে আমার হারাতে হলো বাবা? তোমার বাবার মতো ভালো মানুষ কজন আছেন—তুমি তো সেই বাবার সন্তান—তোমাকে নিয়ে গোটা এলাকা স্বপ্ন দেখেছিল—সেই স্বপ্ন এখন বাংলাদেশের কান্না হয়ে গেল কেন? সারা দেশের মানুষ যেখানে তোমার সাফল্যে উত্সব করবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিল—সেই উত্সব বড়ো অসময়ে লাশ হয়ে চোখের জলে কেন কথা বলছে? এরকম করে তো বাবা, তোমাকে আমরা চাইনি। তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমরা এই শহরে—দেশের সবচেয়ে সেরা বিদ্যাপিঠে তোমার পড়ালেখা তো বটেই—তোমার জীবনেরই নিরাপত্তা দিতে পারিনি। বড়ো এক দুর্ভাগা দেশে জন্মেছিলে তুমি, যে দেশ তার সোনার টুকরো সন্তানকে বাঁচার নিশ্চয়তা দিতে পারল না। তোমাকে যারা হত্যা করল, তারাও তো এদেশেরই সবচেয়ে মেধাবী সোনার টুকরো সন্তান—তারাও তো আমাদেরই সন্তান—আমাদেরই স্বপ্ন—আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্। তারা কেন তাদের প্রিয় বন্ধুকে হত্যা করে? তারা কেন তাদের সোনালি আগামী—সোনার বাংলাদেশের বুক রক্তাক্ত করে? এমন সোনার টুকরো ছেলেরা কেন তবে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মতো পথ বেছে নেয়? কী মোহে তারা এমন পাগল হয়ে যায়? ওরা সবাই তো আমাদের উজ্জ্বল আগামী—সোনার বাংলাদেশ। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, আবরারের বাবা বরকত ভাই কাঁদছে—মা কাঁদছে—ভাই কাঁদছে—কাঁদছে তো গোটা বাংলাদেশ। আবরার, আমরা তো চাইনি বাবা, এভাবে কাঁদুক গোটা দেশ—এভাবে কাঁদুক তোমার গ্রাম—কাদুঁক তোমার পরিবার। তুমি তো এরকম মৃত্যুস্বপ্ন নিয়ে বুয়েটে ভর্তি হওনি। তুমি তো এদেশের উজ্জ্বল আগামীর নির্মাতা হবে বলে সাধারণ একটা গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলে কী দুর্দান্ত মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে। এমন মেধাবী সন্তান ইচ্ছে করলেই কী জন্ম দেওয়া যায়! তাহলে তোমার জন্ম হতে আমাদের এত শত বছর লেগে গেল কেন?

তোমার বাড়িটা তো বাঘা যতীনের বাড়ির পাশেই। সাহসের আলোটা হয়তো সেখান থেকেই জ্বলেছিল অন্তরে তোমার। সেই সাহসেই হয়তো তুমিও চেয়েছিলে এদেশকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে। নিজেকে গড়েও তুলেছিলে সেইভাবে। বাকি ছিল শুধু দুর্বার গতিতে বাকি পথটুকু হেেঁট যাওয়া—তা তো অনায়াসেই পারতে তুমি। আর তাতেই বাংলাদেশের মুখ হয়ে উঠত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। আমরা আনন্দে গর্বে তোমাকে মাথায় তুলে উত্সবের রং মাখতাম। যে ভাবে তোমাকে হত্যা করা হলো—ভাবতে গেলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের সন্তান বড়ো হচ্ছে—এলাকার আলো হয়ে ফুটে উঠছে—আমরা গর্ব করে বলতাম—আবরারের নামে আমাদের গ্রাম একদিন খ্যাত হবে—একদিন আলোকিত হবে। তবে কেন এই অসময়ে কবরের অন্ধকার নেমে এলো তোমার জীবনে? কেন আমাদের সব স্বপ্ন রক্তাক্ত হয়ে লাশ হয়ে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানি না বাবা। আমি তো লেখালেখি করি তুমি জানো—বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি তাও জানতে—তুমি বলতে আমাদের দেখে ঢাকায় এসেছ—আমাদের মতো বড়ো হবে। কিন্তু তুমি জানলে না আমরা তোমাকে নিয়ে কত বড়ো স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের দেখে তুমি যে ঢাকায় এসেছিলে, সেই ঢাকা যে তোমার মৃত্যুকূপ ছিল—আমরাও তো জানতাম না। আমরা এমনই অক্ষম। এই অক্ষমতার কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও ক্ষমা চাই—ক্ষমা করো, আবরার, সন্তান আমার।

একদিন তোমাকে নিয়ে লিখব—এই স্বপ্নটা বুনে রেখেছিলাম—যেদিন তুমি অনেক বড়ো হবে—সাফল্যে আকাশ ছুঁবে—তোমাকে নিয়ে গোটা বাংলাদেশ গর্ব করবে—তখন আমিও তোমার এলাকার সামান্য মানুষ হিসেবে লিখতে চেয়েছিলাম, আবরার, তুমি আমাদের সন্তান। তোমার সাফল্যে দেখো তোমার এলাকার মানুষ আনন্দে পাগল হয়ে গেছে—উড়ছে আকাশে। কিন্তু বাবা, এরকম লেখা তো তোমাকে নিয়ে কোনো দিন লিখতে চাইনি। আমার বুকের ভেতর যে কষ্ট সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে—আমার চোখ ভেঙে যে পানি অঝোরে ঝরছে—আমার কাঁধে যে সন্তানেরই লাশ। তুমি বলতে পারো বাবা, এই লেখাটা আমাকে দিয়ে কেন লেখালে? কারা লেখাল? একবুক কান্না নিয়ে এই লেখার প্রতিটি শব্দ বসাতে হচ্ছে—এ যেন আমার সন্তানেরই কবরে পাথরভারী হাতে মুঠোতে মাটি নিয়ে মাটি ছড়িয়ে দেওয়ার মতো। বাবা, তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তুমি আমাদের দেখে যে ভরসায় ঢাকা এসেছিলে সোনার টুকরো সন্তান হয়ে—আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা করো, বাবা আমার, ক্ষমা করো প্রিয় সন্তান।

ড. রকিবুল হাসান : বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074119567871094