আব্বাসীয় যুগে শিক্ষাব্যবস্থা - দৈনিকশিক্ষা

আব্বাসীয় যুগে শিক্ষাব্যবস্থা

মুফতি তাজুল ইসলাম |

আব্বাসীয় যুগের শিক্ষাব্যবস্থা উমাইয়া যুগের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে রচিত। আব্বাসীয় খলিফারা রাজ্য শাসন ও রাজ্যজয় অপেক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে ইতিহাসে অধিক খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। এ যুগ ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত।

আব্বাসীয় যুগেও বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাপদ্ধতি ছিল না; যদিও সে সময় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অনেক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এবং অনেক মক্তব-মাদরাসাও গড়ে উঠেছিল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুটি রূপ ছিল : ১. প্রাথমিক ও ২. উচ্চ পর্যায়ের। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো স্বাভাবিকভাবে জন্মেছিল মসজিদ ও গৃহাঙ্গনে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইয়াকুত বলেন যে তিনি একজন শেখের গৃহকে বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছেন। ফলে উমাইয়া যুগের মতো বেশির ভাগ শিশু ও কিশোরের শিক্ষাঙ্গন ছিল গৃহাঙ্গন ও মসজিদ। গৃহে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে পিতার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান শিক্ষার হাতেখড়ি নিত সর্বপ্রথম কালিমায়ে তাইয়েবা পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে।

আব্বাসীয় যুগে নারীদের শিক্ষার্জনের প্রসার ও ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। সাধারণ পরিবারের মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ দেখা যায়। অভিজাত ঘরের মেয়েরা Private tutor রেখে ধর্ম ও শালীনতামণ্ডিত সাহিত্য, ছন্দ-শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন। উচ্চশিক্ষার আধার ছিল বায়তুল হিকমাহ। খলিফা আল মামুন ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানে সৌরবিজ্ঞান, অনুবাদ, বিশেষ করে প্রাচীন গ্রিক, সিরীয় ও পারসি সাহিত্যের অনুবাদ, সাহিত্য শিক্ষাদানের মাধ্যমে ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হতো।

ইসলামের ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে প্রথম উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে দরসে নিজামি। সেলজুক সুলতান আলপ আরসালান ও মালিক শাহর আমলে তাঁদের পারসি মন্ত্রী নিজামুল মুলক এ প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা। ১০৬৫-৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণ করা হয়। 

আব্বাসীয় যুগ কলঙ্কের যুগও!

শিক্ষার ক্ষেত্রে আব্বাসীয় যুগ একদিকে যেমন স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, অন্যদিকে এ যুগই মুসলিম তথা ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিকৃতির এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ও। এ অধ্যায়ের সূচনাকারী হচ্ছে খলিফা মামুনের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট মুতাজিলা সম্প্রদায়। মুতাজিলা শব্দের অর্থ হচ্ছে পথচ্যুত। এ সম্প্রদায়ের মতবাদ প্রবর্তক ইরাক নিবাসী ওয়াসিল ইবনে আতা (৬৯৯-৭৪৯)। তিনি তাঁর উস্তাদ হাসান বসরি (রহ.)-এর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য করেন। ‘কবিরা গুণাহকারী মুসলিম নন’—এমন চিন্তা লালন করে তিনি তাঁর শিক্ষক হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিস থেকে উঠে চলে যান। এ মতপার্থক্য হওয়ায় হাসান বসরি (রহ.) ওয়াসেল সম্পর্কে বলেন, ‘ইতাজালা মিন্না—অর্থাৎ সে আমার পথ থেকে সরে গেছে।’ মুতাজিলা মতবাদের প্রবর্তক এই ওয়াসিল ইবনে আতা খলিফা মামুন কর্তৃক গ্রিক, পারসি ও সিরীয় গ্রন্থের অনুবাদকৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পথভ্রষ্ট হন। তিনি ইসলাম, বিশেষ করে আল-কোরআনকে অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে একাকার করে দেখার অপপ্রয়াস চালান। তাঁরা আল কোরআনকে created বা সৃষ্ট গ্রন্থ হিসেবে যুক্তির ভিত্তিতে বিচার করার অপপ্রয়াস চালিয়ে এর ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্য সন্দেহযুক্ত করে তোলেন। ফলে তদানীন্তন কালের প্রখ্যাত পণ্ডিত আবদুল হুজাইন, আমর ইবনে উবাইদ, মুহাম্মদ আল জাবকির প্রমুখ এমনকি খলিফা মামুন পর্যন্ত সবাই আল কোরআনকে নিছক যুক্তি ও বিবেচনার ভিত্তিতে মানবসৃষ্ট দর্শন ও সাহিত্যের কাতারে বিচার-বিশ্লেষণের হীনতম পর্যায়ে নিয়ে আসেন।

ইউরোপীয় গির্জা যুগের (মধ্যযুগ) যাজক সম্প্রদায় তাদের মতবাদের প্রতিবাদকারীদের যেরূপ নির্যাতন করেছিল, আব্বাসীয় আমলে অনুরূপ নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বহু আল্লাহভীরু আলেম মুতাজিলি মতবাদের প্রতিবাদের কারণে। গ্রিক তথা হেলেনীয় (Hellenistic) প্রভাবমণ্ডিত মুতাজিলা সম্প্রদায় ইসলামের ওপর নিছক যুক্তি-চিন্তার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মুসলিম মিল্লাতকে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও দর্শনের মায়াজালে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। এটাই হচ্ছে আব্বাসীয় যুগের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সর্বশেষ কলঙ্কতিলক।

মুসলিম শাসনামলে স্পেনের শিক্ষাব্যবস্থা

আব্বাসীয়দের খিলাফত লাভের পর উমাইয়া বংশের আবদুর রহমান আরব উপমহাদেশ থেকে পালিয়ে কালক্রমে স্পেনে খিলাফত কায়েম করেন। তাঁর বংশধররাই ইতিহাসে মুরিস স্পেন নামে খ্যাত। উমাইয়াদের খিলাফত স্পেনে কায়েম হওয়ার ফলে কালক্রমে গোটা ইউরোপ ও আফ্রিকায় ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়ে পড়ে। মুরদের আমলে স্পেন গোটা ইউরোপ ও আফ্রিকার seat of learning  বা শিক্ষার বেদিমূল হিসেবে গৌরবময় মর্যাদা লাভ করেছিল।

কর্ডোভা, সেভিল, জেইন ও মালাগারের কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য ইতালি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে শিক্ষার্থীরা ভিড় জমাত। শুধু কর্ডোভায়ই ৭০টি পাবলিক লাইব্রেরি, ৭০টি কলেজ ও প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২০০টি স্কুল ছিল।

খলিফা মুনতাসির নিম্ন পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শুধু রাজধানীতেই ২৭টি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিঃস্ব অভিভাবকদের তিনি শিক্ষা ব্যয়ের জন্য দান করতেন অকাতরে। রাষ্ট্রের তরফ  থেকে বিনা পয়সায় বইপত্র দেওয়ারও তিনি ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমলেই কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। অনেকের মতে, এটা কায়রোর ‘আল-আজহার’ এবং বাগদাদের ‘নিজামিয়া মাদরাসার চেয়েও উন্নত ছিল।

স্পেনে প্রায় সবাই পড়া ও লেখা জানত, তখন খ্রিস্টান ইউরোপে পুরোহিত সম্প্রদায় ছাড়া সবাই ছিল নিরেট মূর্খ। এমনকি উচ্চপদের ব্যক্তিরাও! অন্য কথায় মুরদের আগমন, রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিকাশ তখনকার দিনে স্পেনে না ঘটলে আজও বোধ হয় স্পেন শিক্ষা ও সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত থাকত। এর পরিণতিতে গোটা ইউরোপও থাকত নিকষ কালো আঁধারে।

ফাতিমি যুগে শিক্ষাব্যবস্থা

ওমর (রা)-এর সময় মিসর মুসলমানদের অধীনে আসে। সেই থেকে মুসলিম শাসন ও শিক্ষার প্রভাবে দেশটি বিপুল সমৃদ্ধি লাভ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে। কালক্রমে ফাতেমি আমলে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। পরিব্রাজক বেনজামিন তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে (Itinerary) লিখেছেন, তিনি ফাতিমি আমলে ২০টিরও বেশি দর্শনচর্চার প্রতিষ্ঠান দেখতে পান। কায়রোতে সে আমলে অসংখ্য কলেজ ছিল। রাজকীয় বা Imperial Library-তে এক লাখের মতো বাঁধাই করা বই ছিল। অধ্যয়ন করার জন্য বিনা চার্জে এসব গ্রন্থ ধার দেওয়া হতো। ফাতিমিরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের মতোই বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞানানুশীলনে মশগুল ছিলেন। তাঁদের আমলে দারুল হিকমা বা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল।

মরক্কোর ফেজ নগরীতে পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১০০তম বর্ষপূর্তি ঘটে। এই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সময় ছিল ইসলামের সোনালি যুগ। নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে ফেজ নগরী ছিল অনেকটা গ্রামসদৃশ। তখন মরক্কোর শাসক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি এ নগরীকে আইন ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে কবুল করুন।’ সে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ফেজ নগরীর এক বিধবা ধনাঢ্য মহীয়সী নারী চালু করেন কারাওইন মসজিদ। কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় ৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদের অংশ হিসেবে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাতিমা আল ফিহরি নামের এক মহীয়সী নারী। তাঁর বাবা ছিলেন ফেজ নগরীর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আল ফিহরি। আল ফিহরি পরিবার ফেজে আসে নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে। তাঁরা এখানে আসেন তিউনিসিয়ার কারাওইন থেকে। সে সূত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক : শিক্ষক ও খতিব

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056500434875488