আমার শিক্ষাগুরু নিলুফার মঞ্জুর - দৈনিকশিক্ষা

আমার শিক্ষাগুরু নিলুফার মঞ্জুর

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মিসেস নিলুফার মঞ্জুরের সাথে আমার পথচলা ৪ দশকের। আমি জানি তিনি কী ছিলেন আমার জীবনে, আমাদের জীবনে!

'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।'

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং ৭ই নভেম্বর আমার বাবা শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীর বিক্রম) এর নির্মম হত্যার পর আমার পরিচয় জেনে কোন স্কুল কর্তৃপক্ষই আমাকে ভর্তি নেয় নি। ফলে কয়েক বছর আমার লেখাপড়া বন্ধ ছিল। এরপর মিসেস নিলুফার মঞ্জুর পরম মমতায় আমাকে তাঁর সানবিমস স্কুলে ভর্তি করে নেন। বাবার নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোকে আমার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়। তখন তিনি আমাকে তাঁর কাছে রেখে পড়াশোনা করাতেন এবং সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন। মঙ্গলবার (২ জুন) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমি ২০০১ সালে সানবিমস স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি। যে সব বাচ্চাদের বাবা-মা মারা যেত তাদেরকে তিনি আমার ক্লাসে দিতেন এমনি আত্মবিশ্বাস আমার উপর ছিল মিসেস মঞ্জুরের।

আমার পরম সৌভাগ্য তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের আমি ছিলাম ছাত্রী, শিক্ষক এবং আমার তিন ছেলে এখান থেকে পাস করেছে। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি ও আমার সন্তানেরা তাঁকে আমাদের অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর আমি যখন ওনাকে সালাম করতে যাই তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, এতদিন তুমি বাচ্চাদের সুশিক্ষা দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছো, এবার তুমি দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা এবং সততার সাথে কাজ করে তোমার বীর বিক্রম বাবার স্বপ্ন তথা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন পূরণ করো।

আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার দেশপ্রেম আমার ধমনীতে প্রবহমান। কিন্তু তাঁর নির্মম মৃত্যুর পর আমার মা নিলুফার হুদা এবং মিসেস নিলুফার মঞ্জুর আমাদের জাতীয় পতাকার চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করেছেন আমার মাঝে। মিসেস মঞ্জুর স্কুলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝেই দেশপ্রেমের মূল্যবোধ এমনভাবে সৃষ্টি করতেন যে 'সবার আগে দেশ'।

শিশু শ্রেণী থেকে সব ছাত্রছাত্রীর মাঝে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, শিক্ষার্থীরা যাতে শুদ্ধ উচ্চারণে জাতীয় সংগীত গায় এবং জাতীয় পতাকাকে সব সময় সম্মান করেন সেই শিক্ষা দিতেন। আমিও যখনই কোন স্কুল পরিদর্শনে যাই ওনার এই শিক্ষাই পালন করি।

মিসেস মঞ্জুরের দুই সন্তান নাসিম ভাই ও মুনা আপা। কিন্তু বাস্তবতায় তিনি হাজারো সন্তানের মা ছিলেন। আদর্শ শিক্ষা দানে তিনি কখনোই আপস করেননি। তিনি ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকদের সাথে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলতেন। তিনি তাঁর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের নাম মনে রাখতেন এবং বর্তমান শিশু শ্রেণীর বাচ্চাদেরও নাম জানতেন। এটা ছিল তাঁর একটি অসাধারণ গুণ। কোন বাচ্চা যদি আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হতো বা কোনরূপ হতাশায় পড়তো তখন তিনি সবার আগে শিক্ষকদের ডাকতেন এবং প্রশ্ন করতেন কেন বাচ্চাটার এমন হলো? কি হয়েছে বাচ্চাটার? শিক্ষকদের উত্তরে সন্তুষ্ট না হলে তিনি নিজেই বাচ্চাটিকে তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে জানতে চাইতেন তাঁর সমস্যার ও হতাশার কথা এবং পরবর্তীতে করতেন তার সমাধান। এখন আমরা কোথায় পাব মিসেস মঞ্জুরকে যিনি আমাদের হতাশার ও সমস্যার কথা শুনবেন এবং আমাদের শোনাবেন আশার বানী।

মিসেস মঞ্জুর সবসময় শিক্ষা দিতেন বাবা-মা ও শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে, বিনয়ী হতে, ভাল মানুষ হতে, মানুষকে সাহায্য করা, ভালোভাবে কথা বলা, এতিমদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা। তাঁর আরো বড় গুন ছিল, আমরা সবসময় দেখেছি তিনি স্কুলে দোয়া পড়তে পড়তে প্রবেশ করতেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নামাজ পড়ে ওনার পরিবার, স্কুল পরিবার এবং স্কুলের শিক্ষাকর্মী সকলের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে দোয়া করতেন। ও লেভেল পরীক্ষার ঠিক আগের দিন দুপুর ১ টায় আমাদের সকল শিক্ষকদের নিয়ে 'সুরা ইয়াসিন' পড়তেন এবং রাত্রিবেলায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ফোন করে দোয়া করতেন এবং অভয় দিতেন।

পরীক্ষার দিনে মিসেস মঞ্জুর পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে সকল শিক্ষার্থীদের এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে 'আয়াতুল কুরসি' পড়ে সকলকে ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নামে পরীক্ষার হলে পাঠিয়ে দিতেন। উনি যে কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা আমরা সকল অভিভাবকরা দেখেছি।

আমরা বছরের দুইটা দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। সেটা বাচ্চাদের স্কুলের প্রথম দিন এবং সমাপনী দিন। তিনি খুবই সাধারণ কথায় অসাধারণ দিক নির্দেশনা প্রদান করতেন। মায়েদের চোখ পানিতে টলমল করতো এটা জেনে যে, 'মায়ের কোলের মতই সানবিমসের শিক্ষকদের কাছে বাচ্চারা নিরাপদ ও স্নেহে থাকবে'।

আবার ১৪ বছর পরে সেই সকল ছাত্রছাত্রী, বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী আবার কাঁদতেন যখন উনি বলতেন আমার প্রতিশ্রুতি আমি পালন করেছি, আপনাদের কাছে তুলে দিচ্ছি আমার প্রিয় সেই শিক্ষার্থীদের যারা এখন বিশ্ব জয়ের জন্য প্রস্তুত। বাচ্চারা বেলি ফুলের মালা নিয়ে নেমে আসতো স্টেজ থেকে এবং বাবা মার হাতে তুলে দিত আর পেছনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আবেগময় গান বাজতো।

'পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।'

লেখক :  নাহিদ ইজাহার খান, সংসদ সদস্য, মহিলা আসন-৫, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067949295043945