আরেক ৯/১১ এবং সন্ত্রাসের গুরু - দৈনিকশিক্ষা

আরেক ৯/১১ এবং সন্ত্রাসের গুরু

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আরেক বছরের ৯/১১ অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর পার হলো। এই দিনটি নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের ওপর ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণের বার্ষিকী হিসেবে সবাই স্মরণ করে। এর পাশাপাশি আমি এই সময়ে হারিয়ে যাওয়া আরেকটি ১১ সেপ্টেম্বরের কথাও বলতে চাই। সেই ঘটনা আরও আগের; যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

১১ সেপ্টেম্বর বললেই এখন নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্যাবলি মনে পড়ে। সেই যে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের খবর বলার দুই মিনিটের মাথায় সিএনএনসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল অপরাধীদের শনাক্ত করে কথা বলতে থাকল, তারপর সেটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে কত বছর পার হয়ে গেছে! এখনও পুরো বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত দল সুনির্দিষ্ট জায়গায় আসতে পারেনি। কোনোদিন আসতে পারবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু কে আর এসব প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করে? অথচ এর ওপর ভর করেই সারাবিশ্বে মার্কিনি সশস্ত্র তৎপরতা বেড়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন প্রতিপালিত তালেবানদের আবার উচ্ছেদের জন্য যে মার্কিনি যুদ্ধ তৎপরতা শুরু হলো, তা এখনও শেষ হয়নি। ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র আছে- এই অজুহাতে দেশটা ছিন্নভিন্ন হলো। কিন্তু প্রমাণ হলো- পুরোটাই ডাহা মিথ্যা!

এই মিথ্যার ওপরেই আসলে দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। নানারকম 'সন্ত্রাসবিরোধী' নামে, কার্যত নতুন নতুন নিপীড়নমূলক সন্ত্রাসী আইন এবং তার বাস্তবায়নে এক দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। সন্ত্রাস, হিংসা, বিদ্বেষ, অস্থিরতা সবই বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ম-উন্মাদনা, বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি ও বর্ণবিদ্বেষ। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষও এর থেকে রক্ষা পায়নি। একের পর এক সন্ত্রাসের ভয়াবহ গল্প, আতঙ্ক ছড়ানো নানা ঘটনা আর ঘরে ঢুকে এফবিআইর যা খুশি করার স্বাধীনতা মার্কিনি একদিকে প্রতিবাদী, অন্যদিকে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলছে। এর পাশাপাশি চলছে ক'দিন পরপর স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার রক্তাক্ত ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র এক পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যকে যত শৃঙ্খলিত করতে যাচ্ছে, নিজে হচ্ছে ততই শৃঙ্খলিত।

মিডিয়ার অব্যাহত প্রচারণায় যেমন টুইন টাওয়ার ধ্বংসের চিত্র মার্কিনি আগ্রাসন হত্যা-যুদ্ধের যৌক্তিকতা তৈরি করতে সচেষ্ট হয়, তেমনি মিডিয়ার সক্রিয় নীরবতায় ঢাকা পড়ে আরেক ১১ সেপ্টেম্বরের রক্তাক্ত ইতিহাস। সেই আরেক ৯/১১ তৈরি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে; চিলিতে। সেদিন সকালে প্রায় একই সময়ে আকাশে উঠেছিল বহু যুদ্ধবিমান, কোনো বিদেশি আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে নয়; যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে চিলির জেনারেলরা ট্যাঙ্ক, বিমান নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল চিলির জনগণের বিরুদ্ধে; তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আলেন্দের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ চলল, একদিকে প্রায় নিরস্ত্র মানুষ, আরেকদিকে তাদেরই করের অর্থে গড়ে ওঠা চিলিরই সেনাবাহিনী, যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ছিল সিআইএ। যুদ্ধ করতে করতে নিহত হলেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাঁর অপরাধ ছিল- চিলির অর্থনৈতিক সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাত থেকে চিলির মানুষের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা। নিহত হলেন আরও বহু হাজার মানুষ, যারা চিলিতে এক নতুন জগৎ নির্মাণের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নিহত ও আটক হলেন বহু লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী। যে কোনো স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থায় এদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হয় না। কেননা, এদের মধ্য থেকেই মানুষের শক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অসংখ্য মানুষ সে সময় উধাও হয়েছিল। তার হিসাব এখনও পরিস্কার নয়। মার্কিনি পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যার মধ্য দিয়ে সেই সময় ক্ষমতাসীন হয়েছিল জেনারেল পিনোচেট; ইন্দোনেশিয়ার জেনারেল সুহার্তো আর ফিলিপাইনের জেনারেল মার্কোসসহ আরও অনেক খুনি স্বৈরশাসকের মতো। এর পর চিলিতে রক্তক্ষরণ হলো দশকেরও বেশি সময় ধরে।

এসব ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে করিয়ে দিতে মার্কিনি মিডিয়ার গভীর অনাগ্রহ। এসবের মধ্যে অনেক খবর টিভি বা সংবাদপত্রে ঠিকমতো আসেও না। আসে না এ কারণে যে, এ রকম বহু হত্যা, ধ্বংস আর তাণ্ডবলীলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই জড়িত। এগুলো যদি মিডিয়াতে আসে, তাহলে প্রতিদিন দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের সেই বীভৎস চেহারা, কার্যত যা ঢাকতেই বৃহৎ ব্যবসার একনিষ্ঠ সেবক টিভি, সংবাদপত্র, গবেষণা সংস্থা সার্বক্ষণিক নিয়োজিত।

যখন পুরো মার্কিন প্রশাসন সারা দুনিয়ায় সশস্ত্র আগ্রাসনে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে; দেশের ভেতর সব জায়গায় 'নিরাপত্তা' নিশ্চিত করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে নাগরিকদের জানাচ্ছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের নানা ঘটনা দেখাচ্ছে সম্পদ, দাপট আর ক্ষমতা থাকলেই একটি দেশের মানুষের জীবন নিরাপদ হয় না। অন্যান্য দেশ তো বটেই, এমনকি মহাশূন্য দখল যখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে, তখন দেশের ভেতর লাখ লাখ মানুষ দিনের পর দিন কাটাচ্ছে কঠিন দারিদ্র্যে, লঙ্গরখানায়। বিশেষজ্ঞরা দেখান, যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভেতর কীভাবে লালন করে তৃতীয় বিশ্ব, কীভাবে চাকচিক্যের আড়ালে শ্রেণি ও বর্ণগত বৈষম্য মানুষকে বিপর্যস্ত করতে থাকে। কীভাবে পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় দেশ সারাবিশ্বের সর্বত্র ধ্বংসকর্মে চরম দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি একই অঞ্চলের মানুষদের বিপন্ন অবস্থায় চরম নির্লিপ্ত এবং অদক্ষ থেকে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র মানে তাই কেবল টুইন টাওয়ার নয়; দিনের পর দিন দূষিত পানিতে ভাসতে থাকা মৃতদেহও। যুক্তরাষ্ট্র মানে কেবল হাজার মাইল দূরে মুহূর্তে একটি দেশ জনপদ ছিন্নভিন্ন করার, লাখ লাখ মানুষ হত্যার ক্ষমতাই নয়; নিজের দেশের ভেতরে বর্ণবাদী আর শ্রেণিগত নিপীড়নে লাখ-কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করার ব্যবস্থাও। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে এই ব্যবস্থার ঘায়ে তাবত মানুষ যাতে দৃশ্যমান না হয়, সে জন্য আছে তাদের পোষা মিডিয়া। মিডিয়ায় যে যুক্তরাষ্ট্র উপস্থিত হয় তা এক মিথ। তা অনেক কিছু ঢেকে ফেলে। অনেক কিছু অলঙ্কার দিয়ে উপস্থিত করে। একজনের চাকচিক্য দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে ফেলে, যাতে আর শতজনের কঠিন তাড়িত জীবন দেখা না যায়।

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই এখন বৃহত্তম কারাগার। অর্থাৎ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ কারাগারে বাস করে। এক তথ্যচিত্রে একজন মার্কিন গবেষক বলছিলেন, 'বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রে যত কৃষ্ণাঙ্গ কারাগারে আছে, সেই সংখ্যা দাস-বাণিজ্যকালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের চেয়ে বেশি।' আর এই দেশের শাসকরাই প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর খরচ করে অন্য দেশ দখল, গোয়েন্দাবৃত্তি আর গণহত্যায়। এই ব্যয়ে লাভবান হয় ১ শতাংশেরও কম জনসংখ্যার খুবই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী; তেল, অস্ত্র নির্মাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি। নানারকম ভর্তুকি, কর সুবিধা, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষতিকর বিনিয়োগ ও জালিয়াতি, দেশে দেশে অবাধ তৎপরতা এদের উচ্চ আয়ের উৎস। আর এই অর্থেই দেশে দেশে তৈরি হতে থাকে বারবার নানা মাত্রায় ৯/১১।

আনু মুহাম্মদ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003925085067749