উচ্চশিক্ষায় অনৈতিকতা কাম্য নয় - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় অনৈতিকতা কাম্য নয়

গোলাম কবির |

আত্মহত্যা কী দেবতার আশীর্বাদ! কে জানে, হয়তো বা তাই। জীবনানন্দ দাশ আমাদের মতো বোধের গভীরে প্রবেশের অক্ষমতা প্রকাশ করে, বাহ্যদৃষ্টিতে জনৈকের জাগতিক প্রায় সব কিছু বর্তমান থাকা সত্ত্বেও উদ্বন্ধনে আত্মহত্যাকে বলেছিলেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’।

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঁঠালিয়া গ্রামের পরিমল মণ্ডল তাঁর প্রিয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘দেবাশীষ’, যার অর্থ দেবতার আশীর্বাদ। কী পরিহাস! সেই আশীর্বাদ পরিমল মণ্ডলকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করল (১৪.০৫.২০১৮)। ১৭ মে, ২০১৮ কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদনে জানা গেল, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাকি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া দেবাশীষ মণ্ডলের কাছে ১০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। কিছু জমি বিক্রি করে ও বন্ধক রেখে তাঁর বাবা সে টাকা জোগাড় করেছিলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘুষের টাকার অংশ ১০ থেকে ১৫ লাখে উন্নীত করলে অনন্যোপায় দেবাশীষ উদ্ভ্রান্ত হয়ে উদ্বন্ধনে সব চাওয়া-পাওয়ার অবসান ঘটাল। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। বিষয়টি আমাদের দারুণভাবে ভাবিত করে।

ভলতেয়ার মনে করতেন মানুষ অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও আকর্ষণীয় রমণীর জন্য উদ্বাহু হয়ে প্রাণপাত করে। আসলে এরা সমুখ ও প্রশান্তি অপেক্ষা দুঃখ আর অশান্তি ভোগ করে বেশি। বিপরীতে জাগতিক বিত্তবৈভবকে যারা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করতে পারে, তারাই ভারহীনভাবে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ নিমন্ত্রিত হয়। এই অনুভবটি মুখে বলে বাহবা পাওয়া যায়; কিন্তু বাস্তবে কয়জন অনুশীলন করতে পারে! দেবাশীষও পারেননি। তাই সামান্য এতটুকু সুখ, ছোট্ট একখানা বাসা এবং দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জনক-জননীর মুখে হাসি দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় ভালো ফল করে নখদন্তহীন নিরামিষ শিক্ষকতা নামের সুলভ চাকরির উমেদার হয়েছিলেন।

ঘুষ বা উেকাচ নামের বস্তুটি অন্ধকারের পথ ছাড়া শিক্ষকদের ভাগে বেশি জোটে না। জুটলেও পাছে লোকে কিছু বলে ভেবে সন্তর্পণে তফাতে থাকতে চায় অনেকে। আবার যখন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা হওয়ার সুবাদে নিষিদ্ধ ফল হাতের নাগালে চলে আসে, তখন একদা শিক্ষক পদবাচ্য ব্যক্তি, মানুষের রক্তপান করা বাঘের মতো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ফলে জাতি পঙ্কে নিমজ্জিত হয়।

জীবনানন্দের ভাষায় ‘মরিবার সাধ’ দেবাশীষের হয়নি। মৃত্যু তাঁকে তাড়া করেছে জীবনযুদ্ধে ব্যর্থতার কারণে। আর এ ব্যর্থতা রবীন্দ্রনাথের অনুভবে আমাদের সবার অনুষঙ্গের কারণে। যাকে তিনি ‘বলাকা’ কাব্যের ৩৭ সংখ্যক কবিতায় বলেছিলেন : ‘এ আমার এ তোমার পাপ’।

 দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে সত্য-মিথ্যা যাচাই অনেক সময় দুরূহ। ঘটনার অন্তরালে আরো কী রহস্য থাকতে পারে তা খুঁজে বের করা আমাদের মতো নাদানের পক্ষে কঠিন। তবে রটনার সবটাই অলীক বলে উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন নয়। নয় এ জন্য যে বেশ কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছে, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবখানে নিয়োগ বাণিজ্যের আধিপত্য। যোগ্য প্রার্থী কর্তৃপক্ষের চাহিদা মেটাতে না পারলে চাকরি নামের সোনার হরিণ অধরা থেকে যাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। অথচ তার প্রকোপ কমার লক্ষণ দুর্নিরীক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক করতে চেয়েছিলেন। সে বিধি বলবৎ থাকলেও কার্যকর নয়। দলীয় আনুগত্যের লেফাফা, আত্মীয়তার সম্পর্ক, এমনকি হবু আত্মীয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নগদ নারায়ণের কারবার। আর এসব কর্মকাণ্ড স্বাধীনভাবে বাস্তবায়নের মূল হোতা হয়ে পড়ছেন দলীয় পরিচয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। তাঁদের কাছে আদর্শের চেয়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগের স্পৃহা সমধিক।

পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডে আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি। দেখেছি প্রায় সাড়ে চারটি সরকারি কলেজ। এখন জনসংখ্যা পাঁচ গুণেরও বেশি। সে অনুপাত স্মরণে রেখে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাবে, এটা অবশ্যই স্বীকার্য। তাই বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত! সাময়িক জনসমর্থন ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বোধ করি আদর্শ লক্ষ্যাভিসারী জাতির জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। দেখা যাচ্ছে, একসময়ের দেশব্যাপী উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা সনদধারীদের যত্রতত্র ছড়াছড়ি। তাঁরা প্রতিযোগিতায় টেকেন না। ময়ূরপুচ্ছ ধারণা করে দলীয় কেউকেটা সাজে এবং নীতিবহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়েন। যার ফলে অনেকে দেবাশীষের মতো মর্মান্তিক মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়ে চাওয়া-পাওয়ার জগেক তুচ্ছজ্ঞান করে। আবার অনেকে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন ভয়াবহতা তিল তিল করে বহন করতে বাধ্য হয়। এর মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা এবং সেখানে তরুণদের অনায়াস সুখের সন্ধান করা।

বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন মাধ্যমিক পর্যন্ত ব্যাপক কার্যকর শিক্ষার পক্ষপাতী ছিল। আর উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ব্যাপারে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শুধু প্রয়োজনের তাগিদে নয়, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করে রাখার জন্য অপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এখান থেকে বেরিয়ে আসা বেশির ভাগই কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে খাবি খায়। এ সুযোগ নিয়োগের একচ্ছত্র অধিকারের শক্তি মানুষের রক্তের লোভ সংবরণ করতে পারে না বলেই শিক্ষার বেহাল এবং দেবাশীষদের উদ্বন্ধনে দেহত্যাগ করতে হয়। এ প্রবণতা প্রতিহত করা প্রয়োজন।

 লেখক : সাবেক শিক্ষক

রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039999485015869