অনেকের মতো আমিও লুৎফর রহমান রিটনকে ভালোবাসি। প্রিয় এই ছড়াকারের একটা ছড়া দিয়ে লেখাটা শুরু করা যায়-
অতীতে ছিলেন ভিসি শ্রদ্ধার আসনে
ভার্সিটি চালাতেন মমতা ও শাসনে
আজকাল ভিসি মানে মাস্তান। প্রীতি নাই
সম্মান-মর্যাদা-নীতি নাই-নীতি নাই
ইদানিং ভিসি মানে কৌতুক শিল্পী
বিনোদন আইটেম। রসে ভরা জিলেপী
বাজাও তালিয়া জোরে তালি দাও তাল্লি
একেকটা ভিসি যেন সিনেমার চাল্লি
ভিসিদের কাজটা কী? শুধু লোক হাসানো?
এর থেকে মুক্তির আছে কোন আশা? (No)
আশা নাই আশা নাই
ক্ষোভ আর নিন্দার ভাষা নাই ভাষা নাই
(অটোয়া,০৫ নভেম্বর,২০১৯)
জানবিবি(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ও ববির (বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়) ভিসিদ্বয়কে ধন্যবাদ। জানবিবির ভিসি ফারজানা ইসলামকে ধন্যবাদ এ কারণে যে তিনি সত্য বলতে জানেন। তিনি ছাত্রলীগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, তাদের নেতৃত্বে ‘গণ-অভ্যুথ্থান’ হয়েছে এবং তিনি একরকম মুক্ত হয়েছেন। তিনি আনন্দে আছেন এবং তাঁর মন ভালো আছে। অথচ তার মাধ্যমেই একদা জানা গিয়েছিল যে উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকার ভাগ চেয়েছিল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাঁর অভিযোগ অনুসারে কোটি টাকা ‘ঈদ সেলামী’ নেয়া ও অন্যান্য কারণে শোভন ও রাব্বানীকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আবার সেই তিনি ছাত্রলীগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন যা কিনা বশেমরুবিরপ্রবির (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) সদ্য গত হওয়া ভিসি খোন্দকার নাসিরউদ্দীন জানাতে পারেন নি। গদি টিকিয়ে রাখতে তার অনুগত কয়েকজন আর বহিরাগতরা মিলে বশেমুরবিপ্রবি’র আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। স্থানীয় চেয়ারম্যান সফিকুর রহমান বলেছিলেন, হামলাকারীদের কয়েকজন বহিরাগত হলেও ভিসির লোক। অথচ সদ্য গত হওয়া ভিসি নাসির সাহেব বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর কে বা কারা হামলা করেছে তা আমার জানা নেই! সেই দিক থেকে ফারজানা ইসলাম অনেক সাহসী!
আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি কর্মস্থলে যোগ দিতে যেয়ে সহকর্মী বা ছাত্রদের কাছ থেকে ফুল নেন নি।বলেছেন, ‘আমি অশ্রু কিংবা ফুল নিতে চাই বিদায়ের দিন!’ আসুন নির্দিষ্ট সময়ের পর ছাত্র শিক্ষকদের বিদায়ের কান্না আর ফুলে ফুলে ববি’র নতুন ভিসির স্মরণীয় বিদায় হোক সেই কামনা করি আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কিছু মহান কাজের বিবরণ শুনে জ্ঞান লাভ করি।
এক. ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দেয়া প্রথম মানুষ ফারজানা ইসলাম নন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ঢাকার সাতটি কলেজের অধিভূক্তি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড.আখতারুজ্জামানের বাসভবন ঘেরাও করলে তিনি ডেকেছিলেন ছাত্রলীগ কর্মীদের। এরপরের ঘটনা সবার জানা। ছাত্রলীগের বীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে অধিভুক্ত কলেজ শিক্ষার্থীদের মোটামুটি ফ্লাইংকিক মেরে কাবু করে ফেলে এবং উদ্ধার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবরুদ্ধ ভিসিকে!
দুই. ড.আখতারুজ্জামানের মুখ নিসৃত একটা বাণী অমর হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দশ টাকায় এক কাপ চা,একটা সিঙ্গারা, একটা সমুচা পাওয়া যায় যা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় জানতে পারলে গিনেস বুকে রেকর্ড হবে। এখনও ঘটনাটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন জানতে পারলো না সেটার জন্য যে কেউ দুঃখিত কিংবা বিস্মিত হতেই পারেন।
তার অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে নাম ওলট-পালট ও চিরকূট কেলেংকারির রেকর্ড রয়েছে। এছাড়া প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামানের এই চিরকূটের বদৌলতে ছাত্রলীগের কয়েকডজন কর্মী মাস্টার্সে কোনও লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা ছাড়া ভর্তির সুযোগ পান এবং ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হতে পারেন। ভিসি না হতে পারলে ছাত্রলীগের জন্য এতোকিছু করা সম্ভব না!
তিন. ভিসিরা জোকার বা সিনেমার চার্লি না হলে তাদের কর্মকাণ্ড ভাইরাল হতো না। ভাইরালের যুগে এখন ভিসিদের কর্মকাণ্ডও ভাইরাল হচ্ছে। যেমন, জানবিবিতে টাকা ভাগ বাটোয়ারার অডিও ফাঁস এবং ভাইরাল হয়েছিল। এক ছাত্রীর সাথে বশেমরুবিরপ্রবির (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ভিসি খোন্দকার নাসিরউদ্দীনের একটি অডিও ভাইরাল হয়েছিল। তিনি এক ছাত্রীর সাথে যে ভাষায় কথা বলেছিলেন তা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। ভিসির ভাষ্য অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে মেয়েটা নাকি রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কাজ হয় সেটা ছাত্রীর বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন! ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল আরেক উপাচার্যের। সেটা ছিল নাচানাচির ভিডিও। সে যাই হোক এই উপাচার্যের নাম ড.নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাবার অন্যতম শর্তই ছিল নিয়মিত ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকা কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়েই তিনি ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকতেন না। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৯৫ দিনই তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন না কলিমউল্লাহ সাহেব। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৩১ দিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের ভিসি ড.রফিকুল ইসলামের কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছিল। তৃতীয় শ্রেণির এক নারী কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং কথোপকথন ফাঁসের কারণে ২০১৬ তে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
চার. বাংলাদেশে পদত্যাগ কালচার নেই। ভদ্রতা মানে দুর্বলতার মতো পদত্যাগ এদেশে দুর্বলের শেষ অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ভিসি থেকে যেতে চান তার পদে। যে আমলে যে ভিসিই আসুক ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের চরিত্র থাকে একই। পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় থাকে তারা। দখল আর চাঁদাবাজি এবং ভার্সিটিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণই তাদের কাছে আসল। আর ভিসির ক্ষেত্রে পদ আকড়ে থাকাই আসল। আহমদ ছফার বিখ্যাত উপন্যাস ‘গাভী বৃত্তান্ত’ পড়লে বোঝা যায় যে এখন আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমাজ বলে কিছু নাই। আছে হলুদ,বেগুনি, ডোরাকাটা এইসব দল। আপনার দল যত ভারী আপনি তত বড় শিক্ষক, আপনার ভিসি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আপনি কোথায় কবে গবেষণা করলেন, দেশ বিদেশের কোন জার্নালে আপনার কোন গবেষণাকর্ম ছাপা হলো এসবে কারো আর খেয়াল নেই। দলীয় শিক্ষকদের নিয়ে দলবাজি, লোভনীয় পদের জন্য তদবিরবাজি, বিদেশ ভ্রমণ,এনজিও এবং বহুজাতিক কোম্পানির দালালি, এনজিও খ্যাপ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া এসবই কিছু কিছু শিক্ষকের ধ্যান জ্ঞাণ। এই সব কিছু ঠিকঠাক রাখতে এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা পদত্যাগ করতে চান না। ইউনিভার্সিটির ক্ষমতা আকড়ে রাখতে চান।
পাঁচ. সর্বজন বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য নিরাপদ না। মেধা দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা গেলেও সরকারি ছাত্র সংগঠনের দলবাজি ও মাস্তানী, গেস্টরুম ও কমন রুমে টর্চার সেল তৈরি,ভিন্ন মতের ছাত্রদের টর্চার,জোর করে মিছিলে যোগ দেয়ানো একরকম প্রকাশ্য বিষয়। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা সরকারি সংগঠনের ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলাম নিয়োগ পেয়ে প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আছেন। তার বিরুদ্ধে পদ আকড়ে থাকার এবং পুলিশ ও সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন দিয়ে ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে,কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত হয়েছে। যারা ভিসিবিরোধী আন্দোলন করছেন ভবিষ্যতে তাদের সাথে আরেক দফা সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়া এবং তিনমাস ধরে অচলাবস্থার কারণে ফারজানা ইসলাম পদত্যাগ করতে পারতেন। তিনি তা করেন নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অভিযোগ প্রমাণিত হলে ফারজানা ইসলাম ভিসি থাকবেন না আর যারা অভিযোগ ও আন্দোলন করছেন তারা অভিযোগ প্রমান করতে না পারলে তাদেরকেও শাস্তি পেতে হবে।
দেশবাসী প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছেন। বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যেভাবে অভিযুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন, দেশবাসী আশা করে জাহাঙ্গীরনগরেও তাঁর হস্তক্ষেপের পর দ্রুততম সময়ের ভেতর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে এবং ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ফিরবে। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের একাংশ এবং যে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে আছেন তাদের ভেতর ছাত্রছাত্রীরা একটি গান গাচ্ছেন মিছিল শেষে। গানটির কয়েক লাইন এমন-
তারা সবার আগে ঠেকায় মাথা মাননীয়র ঠ্যাংয়ে
আর বুক চিতিয়ে নামটি লেখায় চাটুকারের গ্যাংয়ে
তারা সুবিধাপন্থী
তারা সুবিধাপন্থী শুধুই শান্তি ডিপার্টমেন্ট আর হলে
সিট সংকট আর গবেষণা দুর্জনেরাই বলে
তারা ব্যবসা বোঝে
তারা ব্যবসা বোঝে সুযোগ খোঁজে বাড়ায় ফর্মের দাম
গরীব দুঃখীর টাকা মেরে আনে মায়ের নাম...
ভাইরা টেন্ডার খাবে বিল্ডিং গড়বে ভরবে পকেট ভাই
গাছের গায়ে কুড়াল পরলেও ২ পারসেন্ট চাই...
লেখক: আহসান কবির, সাংবাদিক ও অভিনেতা। বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম।