এ কোন ধরনের সৃজনশীলতা! - দৈনিকশিক্ষা

এ কোন ধরনের সৃজনশীলতা!

মাছুম বিল্লাহ |

সৃজনশীলের সঠিক কোনো সংজ্ঞা নেই, তবে এটি হৃদয়ঙ্গম করা যায় যে শিক্ষার্থীরা কোন বিষয় পড়ে তার ওপর মন্তব্য করতে পারবে, বিষয়টির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উত্থাপন করতে পারবে, নিজের মতামত সেখানে যুক্ত করতে পারবে, সদৃশ কোনো উদাহরণ দিতে পারবে, যোগ-বিয়োগ করে একটি উপসংহার টানতে পারবে এবং সব শেষে একটি বিচারিক মতামত দিতে পারবে। অর্থাৎ পাঠক কিংবা শ্রোতা বুঝতে পারবেন যে লেখক বা বক্তা বিষয়টির ওপর চিন্তা করেছেন, সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন, নিজের মতামত ও উদাহরণ দিয়ে সেটিকে যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণীয় করেছেন পাঠকের কাছে, শ্রোতার কাছে এবং সর্বোপরি একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সৃজনশীলের বিষয়টি মোটামুটি এ ধরনের হওয়ার কথা।

শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু কতটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে, তা যাচাই করতে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় সনাতনি পদ্ধতি বাদ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। এই পদ্ধতিতে বলা হয়, পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন থাকবে সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা থাকবে না। প্রশ্ন থাকবে নির্দিষ্ট সিলেবাস থেকে এবং তারা নিজেদের মতো করে উত্তর লিখবে। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। এখন যা হচ্ছে তা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রশ্ননির্ভর ও গাইড বই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অসম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন হচ্ছে, আর পাঠ্য বই পড়া বা পড়ানো হচ্ছে না। বলা হয়েছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও যোগ্য এক দল শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতির সুফল পাবে।

কিন্তু রিসার্চ ফল অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশনের (রেইস) জরিপ থেকে জানা যায় যে মোট শিক্ষার্থীর এক-চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম। তাদের কাছে কঠিন মনে হয়, বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলো। অরো বলা হয় যে শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই গাইড বইনির্ভর। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সাহায্য নেয়। অন্যদিকে শিক্ষকদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এ পদ্ধতি বোঝে, ৪২ শতাংশ অল্প বোঝে, ১৩ শতাংশ এ পদ্ধতি বুঝতেই পারেনি। ২০০৮ সালে শুরু হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পাঠ্য বইয়ে যে মূল পাঠ রয়েছে এর থেকে প্রশ্ন না করে এরই মূল ভাবের আলোকে বাইরের দৃষ্টান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। সেই দৃষ্টান্ত থেকে জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা—এই চারটি স্তরে বিন্যাস করে প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীরা মূল পাঠের দৃষ্টান্ত অনুসরণে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। আগে মূল পাঠ থেকে পাঠ্য বইয়ে প্রশ্নপত্র থাকত। শিক্ষকরা পরীক্ষার সময় তা দেখে প্রশ্ন তৈরি করতেন। কিন্তু বর্তমানে নমুনা প্রশ্ন থাকে মাত্র একটি। পাঠ বিশ্লেষণ করে বাইরের দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রশ্ন করার কারণে সময় নিয়ে উদ্দীপককে এক ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কোনোভাবেই আত্মস্থ করতে পারছেন না শিক্ষকরা। ফলে শিক্ষার্থীদেরও তাঁরা ভালোভাবে বোঝাতে পারছেন না।

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাত হাজার ৩৫৮টি বিদ্যালয় সুপারভিশন করে জানা যায় যে ৪১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। ৫৯ শতাংশ শিক্ষক পারেন। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক। সাত হাজার ৩৫৮টি তদারকি করা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৭৩৩। এর মধ্যে সৃজনশীলে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ১৯৬ জন।

সৃজনশীলতা বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রাম (সেসিপ) নামের একটি প্রকল্পে। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখা থেকেও সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। তাঁদের মধ্যে কয়জন সৃজনশীল প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, এর সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই। তবে সেসিপ প্রগ্রাম থেকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে পরীক্ষা পদ্ধতি উন্নয়ন বিষয়ে দুই লাখ ২৪ হাজার শিক্ষকের প্রশিক্ষণ চলমান। এ ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষককে সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, এই প্রশিক্ষণেও রয়েছে অনেক ফাঁকি। কারণ সৃজনশীল প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে তৈরি করা হয় মাস্টার ট্রেইনার। এই মাস্টার ট্রেইনাররাই মূলত শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মাস্টার ট্রেইনাররাই ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাঁরা কিভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। জোড়াতালি দিয়েই চলছে এই সৃজনশীলতা। শিক্ষকতা পেশায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সবার ধারণক্ষমতা বা মেধা বা লার্নিং—একই ধরনের হওয়ার কথা নয়; অথচ সৃজনশীলে প্রশিক্ষণ যতটুকু হয়েছে, তা সবার জন্য একই ধরনের। দক্ষ ও অদক্ষ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আলাদাভাবে না দিলে সবাই তা বুঝবেন না, এটিই স্বাভাবিক। সবাই দ্রুত আত্মস্থ করতে পারেন না বিষয়গুলো।

২০১৪ সালের মে মাসে এক অফিস আদেশে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্ন সংগ্রহ করতে নিষেধ জারি করে। ওই আদেশে যেসব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এখনো নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না, তাদের চিহ্নিত করে এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের কথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দিতে মাউশিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এখনো গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। আর প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।

 

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033318996429443