কলেজটি হোক শহীদ বসুনিয়ার নামে - দৈনিকশিক্ষা

কলেজটি হোক শহীদ বসুনিয়ার নামে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শহীদ রাউফুন বসুনিয়া বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া এক বিস্ময়কর সাহসী ছাত্রনেতা। তাঁর জন্ম গ্রামীণ জনপদ বর্তমান রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের পাইকপাড়ায়। তিনি যে বংশে জন্ম নিয়েছেন, তারা ছিলেন ভূস্বামী পরিবার।

রাউফুন বসুনিয়ার এলাকা ছিনাই ইউনিয়ন একদা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ঘাঁটি ছিল। সেখানে অনেক বড় বড় বামপন্থি রাজনীতিক সেই অগ্নিযুগে আত্মগোপনে থাকতেন। এখনও ছিনাই বা রাউফুন বসুনিয়ার গ্রামের বাড়িতে কেউ যদি যান, তারা নিশ্চিত দেখতে পাবেন, এখনও তাদের এলাকায় সুপারি বাগানের চারদিকে বিচুটি পাতার গাছ দিয়ে ঘেরা। যেখানে গাছ আর গাছ। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝি পোকার গান। এ রকম একটি গ্রামে ৩০ আগস্ট ১৯৬১ বসুনিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাউফুন বসুনিয়া। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  বসুনিয়া বংশের লোকজন পড়ালেখায় তেমন আগ্রহী ছিলেন না। যদিও বাড়ির উঠোনেই তাদের পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ব্যতিক্রম ছিলেন রাউফুন বসুনিয়ার পিতা নজরুল ইসলাম বসুনিয়া। তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সন্তানদের পড়ালেখায় মনোযোগী করেছিলেন। তাঁর সন্তানরা হেঁটে বা কদাচিৎ বাইসাইকেলে চরে স্কুলে পড়তে গেছেন। রাউফুন বসুনিয়ার পিতা আলোকিত মানুষ ছিলেন। তাঁর চার ছেলে ও দুই মেয়ে। রাউফুন বসুনিয়ার বড় ভাই ফরচুন বসুনিয়া, ছোট ভাই সাফিন ও নাহিন বসুনিয়া। বোনদের নাম লাকী ও জলি। তাঁর পিতা সন্তানদের নামকরণের ক্ষেত্রে আধুনিক ছিলেন।

রাউফুন বসুনিয়া যখন ১০ বছরের কিশোর, তখন বাঙালির জীবনে মুক্তির দামামা বেজে ওঠে। সঙ্গত কারণে ষাটের দশকের শেষদিক ও '৭০ সালের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের প্রভাব তাদের পরিবারে ছিল। তাঁর ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম শিংহিমারী ব্রাহ্মণপাড়াতেই ছিল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বর্তমানে বামপন্থি আন্দোলনের অন্যতম নেতা শুভ্রাংশু কুমার চক্রবর্তীর বাড়ি। বসুনিয়া পাঙ্গা রানী লক্ষ্মীপ্রিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই রাজনীতির সংশ্রবে আসেন। ছাত্রলীগের স্কুল গ্রুপে যুক্ত হয়ে যান। '৭০ ও ৭১-এ স্কুল থেকে ছুটে গেছেন স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ম্ফূর্ত মিছিলে। '৭০-এর নির্বাচনে নৌকা মার্কার মিছিলে গেছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়ই কারমাইকেল কলেজে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। বাকশাল গঠন হলে তিনি জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠেন। তিনি নবগঠিত জাতীয় ছাত্রলীগের যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তেমনি কেন্দ্রীয় সংসদেরও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর প্রভাবে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম ও রংপুরে জাতীয় ছাত্রলীগ প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে রাজনীতি বন্ধ করে দিলে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা করে ছাত্র সংগঠনগুলো। তাদের তিলে তিলে সংগ্রাম করতে হয়েছে। আশির দশকের গোড়ায় ছাত্র আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন সেলিম, দেলোয়ার, দীপালি সাহাসহ অনেক তরতাজা প্রাণ।

১৯৮৩ সালের ২৭ মার্চ জেনারেল এরশাদ নতুনবাংলা ছাত্রসমাজ নামে একটি ছাত্র সংগঠন তৈরি করলেও ক্যাম্পাসগুলো দখলে নিতে পারেননি। জন্মের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো দখলে নিতে মরিয়া হয়ে পড়ে নতুনবাংলা ছাত্রসমাজ। সে সময় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল। তৎকালীন ছাত্র সংগঠনগুলোর ছাত্রনেতারা ছিলেন সাহসী ও আগুয়ান। যাদের মধ্যে রাউফুন বসুনিয়া ছিলেন অন্যতম।

১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির আগে নতুনবাংলা ছাত্রসমাজ নামে অছাত্র, সন্ত্রাসী পেটোয়া বাহিনী এফ রহমান হলসহ কয়েকটি হলে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করা। সমগ্র দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ কলেজগুলোতে তারা শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার প্রচেষ্টায় থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়। সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো সে কৌশল বুঝতে পেরে গোড়াতেই ভ্রূণ বিনষ্টের চেষ্টা করে। তারা সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে এরশাদের ছাত্র সংগঠনকে বিতাড়িত করতে ঐক্যবদ্ধ হন। সে সময় ছাত্র সংগঠনগুলো কোথাও ঐক্যবদ্ধ, কোথাও যুগপৎভাবে এরশাদের ছাত্র সংগঠনকে প্রতিরোধে নেমে পড়ে। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে রাউফুন বসুনিয়ার নেতৃত্বে একটি সন্ত্রাসবিরোধী জঙ্গি মিছিল মুহসীন হল থেকে বেরিয়ে মূল সড়ক দিয়ে এফ রহমান হলের কাছে চলে আসতেই এফ রহমান হল থেকে মিছিলের ওপর পরিকল্পিত সশস্ত্র আক্রমণ করে নতুনবাংলা ছাত্রসমাজ। সেদিন তাদের গুলিতেই শহীদ হন রাউফুন বসুনিয়া।

রাউফুন বসুনিয়ার মৃত্যুতে সমগ্র জাতি অশ্রুসজল হয়েছিল। এই মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া ছিল সর্বব্যাপী। সমগ্র দেশে ছাত্রসমাজ উত্তাল হয়ে পড়ে। সেই গণরোষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ছাত্রদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে নতুনবাংলা ছাত্রসমাজ নামক হায়েনারা ক্যাম্পাস থেকে লেজ গুটিয়ে চলে যায়। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকাণ্ড দেশ-বিদেশে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এরশাদ ইমেজ সংকটে পড়েন। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও সরকারের বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরশাদ বুঝতে পারেন, ছাত্র সংগঠন তার ক্ষমতার জন্য সহায়ক না হয়ে ক্ষমতা হরণের কারণ হতে পারে। নেতিবাচক পরিণতির কথা ভেবে এরশাদ কৌশল বদল করে নিজের ছাত্র সংগঠনকে বিলুপ্ত করেন, যা রাউফুন বসুনিয়ার রক্তদানেরই ফসল। রাউফুন বসুনিয়ার রক্তের ধারায় গড়ে ওঠা সংগ্রামে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের অপশাসন রুখে দেয় সমগ্র জাতি।

রাউফুন বসুনিয়ার শাহাদাতের ৩৫ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। রাউফুন বসুনিয়ার আদর্শের রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাঁর দল নেতৃত্বে থাকলেও আমরা যথাযথ উদ্যোগের অভাবে রাউফুন বসুনিয়াকে নিয়ে তেমন কাজ করতে পারিনি। ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাড়া তিনি অনুচ্চারিত থাকেন সমগ্র বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হলের মাঠে একটি আবক্ষমূর্তি ছাড়া তাঁর স্মরণে কিছুই নেই। সেটিরও মলিন অবস্থা থাকে বছরজুড়ে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, রাউফুন বসুনিয়ার নিজ উপজেলা রাজারহাটে সম্প্রতি একটি কলেজ সরকারীকরণ হয়েছে। কলেজটি একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীর নামে, যে কিনা পাকিস্তানি দালাল ও চাকিরপশার ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আমরা অবগত আছি, সরকারের নীতি ও উচ্চ ন্যায়ালয়ের নির্দেশনাও আছে যে কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ হবে না। সংশ্নিষ্টদের অনুরোধ, যে যার অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করুন, প্রস্তাব আনুন- মীর ইসমাইল হোসেন সরকারি কলেজটির নাম পরিবর্তন করে 'শহীদ রাউফুন বসুনিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয় রাজারহাট' নামকরণ করার।

শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ ও সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী নানা সংগ্রামে শহীদের নামেও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হোক। এই নামকরণ শহীদ ও বরেণ্যদের যত না উপকারে আসবে, তার চেয়ে বেশি উপকার হবে জাতির। নতুন প্রজন্ম এসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেখে নিজেদেরও জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করতে ব্রতী হবেন।

লেখক:  এস.এম. আব্রাহাম লিংকন, আইনজীবী; রাকসুর সাবেক এজিএস; প্রতিষ্ঠাতা, উত্তরবঙ্গ জাদুঘর কুড়িগ্রাম

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0086901187896729