মেধাবী শিক্ষকেরা দেশে ফিরছেন না কেন? - দৈনিকশিক্ষা

মেধাবী শিক্ষকেরা দেশে ফিরছেন না কেন?

সজল চৌধুরী |

‘প্রথম আলো’ অনলাইনে গত ২৫ জুন ২০১৮-তে ‘বিদেশমুখী শিক্ষক ও ফিরে না আসার দেশপ্রেম’ শিরোনামে আমার লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই অনেকের কাছ থেকে অনুরোধ আসছে এর উল্টো পিঠটিকে নিয়েও লেখার জন্য। কারণ মুদ্রার এক পিঠ থাকলেও উল্টো পিঠটিও তো থাকে; যা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হওয়া জরুরি বৈকি! গত লেখাটিতে মূল বিষয় ছিল আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষকই উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁদের চাকরি রেখে নির্দিষ্ট চুক্তিপত্র সম্পাদনের ভিত্তিতে দেশের বাইরে থেকে পড়া কিংবা গবেষণা শেষ করেও শর্তমাফিক ঠিক সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত আসতে চান না।

এমনকি অনেকেই সময় বাড়িয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পদ যেমন ধরে রাখছেন, ঠিক তেমনি দেশকে তাঁরা বঞ্চিত করছেন উচ্চশিক্ষার বিকাশে। সোজা কথা, দেশে ফেরত আসতে না চাইলে শুধু শুধু তাঁরা তাঁদের শিক্ষকতার পদটি আটকিয়ে না রেখে আরেকজন মেধাবীকে সুযোগদান করাই এ ক্ষেত্রে শ্রেয়। লেখাটিতে বলা হয়নি যে দেশের বাইরে শিক্ষকেরা কেন থাকবেন না? থাকুন, তাতে কারও কোনো সমস্যা নেই। বরং মূল বিষয়, যখন শিক্ষা ছুটি শেষে দেশে ফিরছেন না কিংবা দীর্ঘায়িত করছেন শিক্ষা ছুটি, আবার নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর প্রাপ্যতা বুঝিয়েও দিচ্ছেন না, তখন শিক্ষক হিসেবে এ দায়ভার কে নেবে? তবে দেশে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, বিদেশ থেকে ফিরে তাঁদের সঙ্গে কথা বললে আবার অন্য রকম অব্যক্ত কিছু কথা শুনতে হয় তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে।

বেশির ভাগের মতে, এখানে শিক্ষকতায় নিষ্ঠা নিয়ে থাকা অনেক কষ্টকর। বিশেষ করে যাঁরা শুধু শিক্ষকতা আর নিজেদের গবেষণা নিয়ে থাকতে চান, তাঁদের তো আরও সমস্যা। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষক মৌলিক কোনো বিষয়ে গবেষণা করতে চাইলে তাঁকে নিয়মের বেড়াজালে পড়ে প্রায়ই হাঁসফাঁস করতে হয়। এমনকি সরকারিভাবে গবেষণার জন্য যে ন্যূনতম থোক বরাদ্দ আছে, সেই অর্থ হাতে আসতে আসতেও অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ‘গবেষণা করব, নাকি ফরমালিটি সামলাব, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি?’ সে ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আরও সহজ কিছু পন্থা গবেষকদের উৎসাহিত করার জন্য অবলম্বন করতে পারে গবেষণা আর উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে।

এরপর অনেকের ভাষ্য অনুযায়ী, আপনাকে বিভিন্ন দলের রঙে নিজেকে রাঙাতে হবে, নতুবা অনিয়ম-দুর্নীতি মেনে মাথা নিচু করে হাঁটতে হবে। এগুলো বন্ধ না হলে মেধাবীরা দেশে থেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রাখার ব্যাপারে একেবারেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। কারণ তাঁদের মতে, যোগ্য মেধাবী শিক্ষকেরা এসবের ভেতর থাকতে পারেন না কখনো, যেখানে কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিদেশের ল্যাবে বসে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের উন্নত গবেষণা, যার প্রতিফলন বিশ্বের নামকরা অনেক বিজ্ঞান সাময়িকীতে পাওয়া যায় অহরহ। এমনকি সব সময়ই দেখা গেছে, যে শিক্ষক দেশের বাইরে আছেন, প্রতিবছরই দু-তিনটি কিংবা এর বেশি গবেষণায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখছেন, প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন। কিন্তু দেশে ফেরত এসে নিজেদের বিভাগে যোগ দেওয়া অধিকাংশ শিক্ষকের একই অভিমত, ‘গবেষণা করার মতো হাতে আর সময় নেই...?’ তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন একাডেমিক অনেক কাজে, যাকে শুধু ‘ম্যানেজেরিয়াল জব’ বললেও ভুল হবে না মোটেও। অথচ তাঁদেরই এখন বেশি সময় দেওয়া উচিত নতুন শিক্ষাপদ্ধতি এবং গবেষণার উন্নয়নে। আর এ বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানকে আরও আন্তরিকতার সঙ্গে দেখা একান্ত প্রয়োজন তাঁদের নিজেদের উন্নতির স্বার্থেই। কারণ, মনে রাখতে হবে, শুধু অর্থ দিয়েও কিন্তু ভালো কিছুর আশা করা যায় না, প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ ও কাজের স্বাধীনতা। আর এ বিষয়টিই আমরা একেবারে ভুলে বসে আছি অমায়িকভাবে।

তা ছাড়া আমাদের দেশে এখনো শিক্ষক নিয়োগের বেলায় শুধু স্নাতক পর্যায়ের উচ্চ নম্বরকেই সর্বোচ্চ মেধার প্রমাণ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ের পরের গবেষণা কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে যতই উন্নতি করুক না কেন, সেগুলো হয়ে যায় গৌণ। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে পড়ার আরেকটি বড় কারণ এই পুরোনো আমলের ধ্যানধারণা। বিশেষ করে, বিশ্বের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণত মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, সেখানে শুধু নম্বরভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগের বেলায় অনেক বেশি মাত্রায় দেখা হয়, প্রতিবছর তার ধারাবাহিক গবেষণার উন্নয়ন, শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য একাডেমিক অবদান যাকে আমরা ‘কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি’ বলে থাকি। এ ছাড়া গবেষণায় অর্থ জোগাড়ের দক্ষতা, এমনকি তাঁর মধ্যে শিক্ষক হিসেবে ‘মোটিভেশনাল’ ক্ষমতা আছে কি না, ইত্যাদিকে। উচ্চ সিজিপিএ দরকার, তবে তাঁদের কাছে সেটিই সবকিছু নয়। অথচ আমরা এভাবেই চলছি বছরের পর বছর ধরে, আর চলার পথে হোঁচট খাচ্ছি প্রতিনিয়তই। তাই শিক্ষায় সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আমাদের এগুলো অবশ্যই ভাবতে হবে। প্রকৃতপ‌ক্ষে যাঁরা নিজেদের দিনের পর দিন ধরে মেধাবী থেকে আরও মেধাবী করে তুলছেন, তাঁদের সুযোগ দিতে হবে। তবেই তো তাঁরা দেশে ফেরায় উৎসাহিত হবেন।

সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষককেই ভাবতে দেখেছি, সেটি হচ্ছে গবেষণা খাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ। ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে গবেষণাক্ষেত্রে আলাদা অর্থায়নের ব্যবস্থা আছে, যার মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন গবেষক মৌলিক গবেষণায় অংশ নিতে পারে। অথচ আমাদের দেশে এগুলো নিয়ে তেমন কোনো বিকার নেই কারও—যার কারণে অনেকেই বিমুখ হয়ে বেছে নেন প্রবাসী গবেষকের জীবন। এমনকি দেশে যা-ই গবেষণা হচ্ছে না কেন, এরও যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার বেলায় আমলাতান্ত্রিক কার্পণ্য যেন সব জায়গায়। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় ভাবতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে—সময় থাকতেই।

অনেকেই আবার শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের মানসিকতাকে দায়ী করেছেন দেশে না ফেরার অন্যতম কারণ হিসেবে। কারণ তাঁদের মতে, মেধার দাম যেখানে আছে, সেখানেই তো মেধাবীরা যাবেন। এমনও বলতে শোনা গেছে, উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরত এসেছেন ঠিকই, ফলও ভালো কিন্তু কোনো এক নিয়মের বেড়াজালে তাঁরা দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারছেন না এবং দিন শেষে আবার বাইরে চলে যাচ্ছেন। তা ছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়, অবস্থান ও শিক্ষকভেদে অনেক বৈরী নিয়মের প্রচলনকেও অনেকেই দায়ী করেন এমন অবস্থার জন্য। আজ দেশে মেধার মূল্য যদি সঠিকভাবে মেধাবীরা পান কিংবা শতভাগ না পেলেও যদি পাওয়ার ব্যবস্থাপনা কিংবা নিয়মনীতি সঠিক থাকে, তাহলে তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী অবশ্যই তাঁরা দেশে ফিরে এসে শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতিতে হাত লাগাবেন। আর সেই সুযোগের অপেক্ষায় আজ আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি। কারণ দেশের উন্নতির জন্য মেধাবীদের যোগসূত্র অবশ্যই প্রয়োজন, সে জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন।

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

 

সৌজন্যে: প্রথম আলো

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065019130706787