এবারের মতো বইমেলা সাঙ্গ হওয়ার ঘণ্টা বেজে গেছে। এ বছর বাংলা একাডেমির অভ্যন্তর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার পরিসর বেড়েছে। বেশ খোলামেলা হয়েছে। হেঁটে চলে স্টলে বা প্যাভিলিয়নের বই দেখে অনেক বেশি স্বস্তি ছিল এবার।
তবে অধিকাংশ প্রকাশকের মন বিশেষ ভালো নেই। জিজ্ঞেস করলেই বলেন, ‘নাহ! বেচাবিক্রির অবস্থা ভালো না। মেলায় আসা বেশির ভাগ মানুষকে পাঠক বলা যায় না। তারা বেড়ানোর আনন্দ নিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে বই স্টলের কাছে দাঁড়ান। নেড়ে চেড়ে দেখেন। বই সামনে রেখে সেলফি তোলেন। তারপর খালি হাতে বা ক্যাটালগ নিয়ে চলে যান। এখন তো আমাদের স্কুল-কলেজপড়ুয়া প্রজন্মকে আর শিক্ষার্থী বলা যায় না। সবাই পরীক্ষার্থী।
চলমান শিক্ষাপদ্ধতিতে বর্তমান প্রজন্মকে পরীক্ষার জালে বন্দি করে ফেলেছি। স্কুল, কোচিং আর প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার বাইরে ওদের ফেসবুক ছাড়া আর কোনো জীবন নেই। সময় কোথায় যে, আনন্দের জন্য মুক্তভাবে মুক্ত বিষয়ের বই পড়বে! এসব বাস্তবতার প্রভাব তো বইমেলায় পড়বেই।
ছেলেবেলায় দেখতাম স্কুলে এবং পরিবারের ভেতরে ক্লাসের পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার প্রণোদনা থাকত। গ্রামে বা মহল্লায় পাঠাগার গড়ে তোলা হতো। বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল এ সপ্তাহে কে ক’টা বই পড়েছি তা নিয়ে। আমাদের হাতে বিজ্ঞানের অনেক আশীর্বাদই এসে তখনও পৌঁছেনি। ফলে সময় কাটাতে স্কুলের বাইরে খেলাধুলা আর বইপড়া বিনোদনের অংশেই পরিণত হতে লাগল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রেডিওর পাশাপাশি বিটিভি কিছুটা বিনোদনের উৎস ছিল। তবে তা বইপড়ার অভ্যাস ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় তেমন বিঘ্ন ঘটায়নি। বরঞ্চ বলা যায়, সাংস্কৃতিক আবহকে কিছুটা প্রণোদনাই দিয়েছে। একুশ শতকের শুরুর দিকে আমরা আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হলাম। দিনে দিনে অনেক টিভি চ্যানেল হল। প্রাইভেট অনেক রেডিও সম্প্রচার শুরু করল। চ্যানেলের কল্যাণে হিন্দি সিরিয়াল আর হিন্দি ছবি তরুণ প্রজন্মকে অনেকটাই বন্দি করে ফেলল। তখন এদের একটি বড় অংশ পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রস্তুতি ছাড়া বই পাঠ আর নন্দনচর্চায় খুব একটা সময় বের করত পারছিল না।
এবার দাবানলের মতো প্রবেশ করল ফেসবুক, টুইটার ধরনের আধুনিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এসবের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করতে চাইছি না। নতুন প্রজন্ম স্কুল-কলেজের দায় কিছুটা মেটাতে পারলেও ফেসবুক গ্রাসে তারা অনেকটাই বিপর্যস্ত। ক্লাসে অমনোযোগিতা বেড়েছে। টের পাই পেছনের দিকে বসা ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই স্মার্ট ফোনের বাটন টিপছে। অনেক বাবা-মাকে দেখি শিশু সন্তানটিকে ট্যাব কিনে দিয়ে ট্যাবাসক্ত করে দিয়েছেন। এদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে আমার শঙ্কা হয়। এ বাস্তবতায় বই পড়ায় মনোযোগী করে তোলা তো হবে সাধনার ব্যাপার।
আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের আমরা অদ্ভুত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রিত জীবন উপহার দিয়েছি। ওদের কারও মুক্তচিন্তা করার মতো জীবন নেই। পাঠক্রমবহির্ভূত পাঁচটি বইয়ের খোঁজ রাখার সময় ওদের নেই। জিপিএ ৫ অর্জন ছাড়া ভবিষ্যতের আর কোনো স্বপ্ন নেই।
শহরকেন্দ্রিক হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ ছাড়া অধিকাংশ কলেজে শিক্ষকরা মনে করেন না নিয়মমাফিক কলেজে যেতে হয়। আর গেলেও ক্লাস নিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা মনে করে শিক্ষক নির্দেশিত নোট-গাইড সংগ্রহ করার বাইরে ক্লাসে যাওয়ার খুব একটা আবশ্যকতা নেই। ফলে ক্লাসের বই বলতে যারা গাইড বই বোঝে, তাদের কাছে পাঠবহির্ভূত বইয়ের খোঁজ রাখার আবশ্যকতা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়কে কি এ অবস্থা থেকে দূরে রাখা যাবে? আমার মনে হয় না। আকাশ সংস্কৃতি আর ফেসবুক-টুইটার সংস্কৃতির ভেতর অবগাহন করতে গিয়ে অনেকের কাছে বই বিস্ময়ের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এখন তরুণদের অনেকেরই কানে হেডফোন আর হাতের মোবাইল সেটে অনবরত আঙুলের ছন্দময় দোলা। বই পড়ার সময় কোথায় ওদের! ভোরবেলা হাঁটতে গিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় দেখে নতুনভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম। তাহলে নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কি আবার লাইব্রেরিমুখো হতে শুরু করেছে? খোঁজ করে জানলাম বিষয়টা তেমন নয়। এখন লাইব্রেরিতে আসন পাওয়া ভার। বিসিএস বা অন্য কোনো চাকরি প্রত্যাশীরা নিজেদের প্রস্তুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবেলায় এসে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে। ভাগ্যিস স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখন আর তেমন লাইব্রেরিতে যাওয়ার সময় পায় না। নয়তো লাইব্রেরিতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ার জন্য এতদিনে আন্দোলন শুরু করে দিত।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দিনব্যাপী ইতিহাস একাডেমির বার্ষিক আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলন হয়ে গেল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক গবেষক এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের এ গবেষক-শিক্ষক বন্ধুরা একই আক্ষেপ করে বললেন, ফেসবুক-সংস্কৃতি জ্ঞানচর্চার জায়গা থেকে তরুণদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এর প্রামাণ্য উদাহরণ পেয়েছিলাম গত বছর কলকাতা বইমেলায় গিয়ে। ২৬ জানুয়ারি ২০১৭-তে কলকাতায় শুরু হয়েছিল বইমেলা। আমি ২৭ জানুয়ারি বিকালে মেলায় গিয়েছি। কলকাতা বইমেলার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আগে যখন ময়দানে বইমেলা হতো তখন অনেকবারই সেখানে গিয়েছি। এখনকার তুলনায় ময়দানের বইমেলা অনেক বেশি জাঁকালো ছিল। দীর্ঘ লাইন ধরে টিকিট কেটে মেলায় ঢুকতে হতো। আমি গত শতকের ৯০-এর দশকের কথা বলছি। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে একটি স্মৃতি কথা অনেক লেখাতে লিখেছি। বলেছি লাখ লাখ বইপ্রেমিক মানুষকে দেখেছি যাদের অধিকাংশই হাতভরা বই কিনে বাড়ি ফিরছে। তখন আফসোস করে বলতাম, আহা, আমাদের একুশের বইমেলায় দর্শকদের অর্ধেকও যদি বই কিনত তাহলে আমাদের প্রকাশনার চেহারাটাই পাল্টে যেত।
গত বছর কলকাতা বইমেলায় দেখেছি যেন একই হাওয়া বইছে দুই বাংলায়। কলকাতা বইমেলা চলে গেছে এখন সল্টলেকে। বড় বড় প্যাভিলিয়ন খুব কমই চোখে পড়ল। বাংলাদেশের প্রায় ত্রিশটি প্রকাশনা সংস্থার স্টল ঘিরে একটি আলাদা প্যাভিলিয়ন করা হয়েছিল। কান্তজির মন্দিরের আদলে করা বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটিকেই একমাত্র আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল আমার। কলকাতা বইমেলায় এখন আর টিকিট কাটতে হয় না। তেমন কিউ দিয়েও আমাদের ভেতরে ঢুকতে হল না। বই ছাড়াও সেখানে ছিল নানারকম খাবারের দোকান। তাঁত বস্ত্রের দোকান, আচার, চাটনির দোকান। বইয়ের দোকানের চেয়ে এসব দোকানেই ভিড় তুলনামূলকভাবে বেশি। মেলা থেকে বই কিনে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যাও বেশ কমে গেছে। আমার সঙ্গে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন বারাসাত কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ও লেখক রাজকুমার চক্রবর্তী। তিনিও অভিন্ন হতাশা ব্যক্ত করলেন। আসলে ‘অবসরে বই পড়া’ বলে একটি কথা ছিল। এখন তো ফেসবুক, টুইটার আর আকাশ সংস্কৃতি এবং নানা পরীক্ষার চাপে অবসর বলে কোনো কিছু নেই এই প্রজন্মের। তাই অবসরে বই পড়া ক্রমে নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা হয়ে পড়ছে।
আমি দেখেছি- অনুভব করেছি কলকাতা বইমেলার চেয়ে একুশের বইমেলার চরিত্র এবং আবেগ আলাদা। একুশের বইমেলা অনেক বেশি গোছাল। বই প্রকাশ নিয়ে প্রকাশকদের পরিমার্জনাও একটু আলাদা। অনেক বছর ধরেই মেলায় আসা মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় বইমেলার বড় অংশ এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আকর্ষণীয় স্টল সাজিয়ে বসেছেন প্রকাশকরা। একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বলছিলেন, যত মানুষ প্রতিদিন মেলায় আসেন তাদের দশ ভাগও যদি বই কিনতেন তাহলে মেলার চেহারাটাই পাল্টে যেত।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আমাদের দেশের মতো সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। মৌলিক শিক্ষার পর ডিপ্লোমা ধরনের নানা শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের পর কর্মক্ষেত্রে চলে যায়। আর গবেষণার ক্ষেত্রে যারা থাকতে চায় তারা বিশেষায়িত বিদ্যায় নিজেদের যুক্ত করে। তাই ওদের কারিকুলামই এমন যে, সেমিস্টারে ঢুকে অনেক কিছুই পড়ে, তবে কোনো কিছুর গভীরে যাওয়া হয় না। আমাদের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (অধুনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেও) কারিকুলাম ও সিলেবাস এসব আধুনিক দেশের দর্শনেই পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা পাশ্চাত্য দেশে পাড়ি জমায় অথবা ক্রেডিট ট্রান্সফার করে, তাদের না হয় একটি জীবন তৈরি হয়; কিন্তু দেশে যারা থাকে তাদের অনেকেই জ্ঞানের রাজ্যে না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে থাকে।
এ দেশে নানা নীতিনির্ধারণী খেলায় বিভ্রান্ত আমরা আসলে নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করে তুলতে পারছি না। আমি দেশের অন্যতম নামি এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। ক্লাসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ ছাত্রছাত্রী একুশের বইমেলা সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার কিছু জানে না। পাঁচ শতাংশ ছাত্রছাত্রী জানে না কোথায় বসে একুশের বইমেলা। প্রায় ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কখনও বইমেলায় যায়নি। এখানকার শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নিয়মের খাঁচায় বন্দি। ক্লাস-পরীক্ষা দিতে দিতে এরা তিন মাসের সেমিস্টারে নোট আর হ্যান্ডআউটের বাইরে যাওয়ার সময় পায় না। যারা সংবাদপত্র পড়ার ধারণা হারিয়ে ফেলছে, তারা পরীক্ষার অক্টোপাস বেষ্টনীর বাইরে গিয়ে কীভাবে বইপড়ার জগতে প্রবেশ করবে! তা ছাড়া যখন জানতে পারে এ বইমেলায় থাকা বেশির ভাগ বই বাংলা ভাষায় লেখা, তখন ওরা আরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ বাংলা ভাষা চর্চার সঙ্গে ওদের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ।
এভাবেই আমাদের নতুন প্রজন্ম জ্ঞানচর্চার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যারা দেবে, তাদের এমন বইবিমুখ জীবনে সঞ্চয় বেশি থাকার কথা নয়। সুতরাং ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যৎ কি অপেক্ষা করছে না আমাদের জন্য? বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলের ভাবনা সম্প্রসারিত হলেই মঙ্গল।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: যুগান্তর