আমাদের দেশে রাজনৈতিক টালমাটাল উত্তেজনার সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতিসচেতন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার কথা ভেবেছিল। তবে খুব বেশিসংখ্যক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী রাতারাতি ছাত্রসংগঠনে যুক্ত হয়েছে তেমনটি দাবি করা যাবে না। যদিও ১৯৪৮-পরবর্তী ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজনীতি পূর্ব বাংলায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তার লাভ করেছিল, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় অধ্যায় রচিত হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন শেষে শিক্ষার্থীরা আবার লেখাপড়ায় ফিরে গেছে। নবগঠিত ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ষাটের দশকে শিক্ষার আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নিলেও তা কোনো অবস্থায়ই কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে আবদ্ধ ছিল না। শিক্ষার অধিকারকেন্দ্রিক এই আন্দোলন পূর্ব বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ ও রাজনীতিসচেতনে সহায়তা করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গণ-অভ্যুত্থান এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, তবে ছয় ও ১১ দফাকেন্দ্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ পূর্ব বাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সংগ্রামকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে অবদান রাখলেও নিজেদের গণ্ডি অতিক্রম করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা একেবারেই জাতীয় জীবনের বিষয় ছিল। এতে ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা ছিল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনো নীতি-কৌশল বিশ্ববাস্তবতায় নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে ছাত্রসংগঠনগুলো দ্রুতই রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনে পরিণত হতে থাকে। ছাত্রসংগঠন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে প্রভাব বিস্তারের সংগঠিত শক্তিরূপে। ১৯৭২-৭৫ সময়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতির তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়, ‘ছাত্ররাজনীতি’র ধারণা তখন জাতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। কিছুটা পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র না বুঝে আমরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করি, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ার সংগঠন হিসেবে দেখতে শুরু করি। ভবিষ্যৎ নেতা তৈরির কারখানা হিসেবে ছাত্রসংগঠনকে ভাবার পাশাপাশি এগুলোকে আদর্শবাদী নীতি-পরিকল্পনায় কিভাবে পরিচালিত না করার পরিণতি কী হতে পারে তা কেউ ভেবে দেখেনি।
১৯৭৫ সালের পর জাতীয় রাজনীতিতে যে সর্বনাশা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা অবস্থায় রাখা হয়, আদর্শহীন ও পরিত্যাগকারীদের মাঠে আনার পথ করে দেওয়া হয়, সেই পরিস্থিতিতে সব কিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। ছাত্রসংগঠন ভাঙাগড়ায় পড়ে।
আশির দশকের মাঝামাঝি আবার ছাত্ররাজনীতি স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগানে রাজনীতির মাঠে নামে। তবে তারা যখন আন্দোলনের মাঠে তখন ছাত্রশিবির ঢাকা ছাড়া দেশব্যাপী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তাদের দখল প্রায় একচেটিয়া করে ফেলে। ছাত্রশিবির স্বৈরাচারবিরোধী বা নব্বইয়ের অভ্যুত্থানেও ছিল না। ছাত্রশিবির ইসলামী বিপ্লব সংঘটনে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করে। ধর্মীয় আবেগ আর পরবর্তী কর্মসংস্থানের হাতছানিতে অনেক তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়। ২০০৮-২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে হানাহানি, দখলদারির লড়াইয়ে ছাত্রশিবিরই গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল। ১৯৭৫-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মূল্যায়নে যে হতাশার চিত্র ফুটে ওঠে, তা থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ না রাজনৈতিক, না শিক্ষিত সমাজের মধ্যে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অধিকন্তু আবেগ আর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে ‘আদর্শিক’ করার নসিহত দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। খুব সহজ বটিকা হিসেবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ক্ষমতা, বিত্ত ও ধর্মের নাম ব্যবহার করে ‘নেতৃত্বে’র আসন লাভ করা যায়, তা দিয়ে দেশের শিক্ষা ও রাজনীতি কলুষিত, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া তেমন কোনো লাভ নেই। গত চার দশকে দেশের ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রসংগঠনগুলো মেধাহীনদের কবজায় চলে গেছে, লেখাপড়ার চর্চা কোনো ছাত্রসংগঠনে নেই, মেধাবীদের জায়গাও সেখানে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহারা দেওয়া, হল-হোস্টেল দখলে নেওয়া এবং নানা ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া ছাড়া এসব মেধাহীন লেখাপড়াবিযুক্ত নেতৃত্ব ছাত্রসংগঠন ও তথাকথিত ছাত্ররাজনীতিকে দেওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখে না।
বিষয়গুলো যে এখন নির্মোহ দৃষ্টিতে অন্তত বোদ্ধাদেরও দেখা উচিত সেটি হচ্ছে না, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ভাবার সময় এবং জ্ঞান রাখেন বলে মনে হয় না। মূল সমস্যাটি দেখতে হবে শিক্ষার মানসম্মত ধারণার ভেতরেই। পৃথিবীর উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে বা গণতান্ত্রিক দেশে ‘ছাত্ররাজনীতি’ বলে আলাদা কোনো ধারণা নেই। ১৮ বছরের যেকোনো নাগরিক ভোটদানের অধিকার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের যেকোনো রাজনৈতিক দল পছন্দ করা, ভোট দেওয়া ইত্যাদি অধিকার আপনা থেকেই রাখে। তাকে রাজনীতির জন্য অন্য কোনো সংগঠনে যুক্ত হয়ে, প্রশিক্ষিত হয়ে রাজনীতি করতে হবে, এমন কোনো সিঁড়ি রাখার প্রয়োজন নেই। স্কুল-পরবর্তী শিক্ষাজীবনকে সেসব দেশে বিষয়-বিশেষজ্ঞ হওয়ার ব্যাপক জ্ঞানসাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত যেকোনো নাগরিক তার দেশে গণতন্ত্রের সহায়ক দল কোনটি, আবার ক্ষতিকর কোনটি তা সহজে বাছাই করার জ্ঞান রাখে। কেননা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাক্রম এমনই দর্শনযুক্ত যে ডাক্তার, প্রকৌশলী হলেও সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির শিক্ষাটি তারা অনায়াসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পেয়ে থাকে।
উচ্চশিক্ষা লাভ করা মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়, কম পড়ে গাইড বই পড়ে, ক্লাস না করে, পর্যাপ্তসংখ্যক বই-পুস্তক না পড়ে উত্তীর্ণ হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। আমরা যারা উন্নত দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি তাদের শিক্ষাজীবনে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। উচ্চশিক্ষা পরীক্ষাকেন্দ্রিক নয়, বরং গবেষণা ও লেখালেখির বাধ্যবাধকতাকেন্দ্রিক থাকায় দেশের কর্মজীবনে আমাদের বেশির ভাগ ডিগ্রিধারীই কিছু না কিছু করতে সক্ষম হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে উচ্চশিক্ষার পুরো পাঁচ-ছয় বছর ক্লাস, লাইব্রেরি, পড়াশোনা, হোস্টেলে ঝামেলামুক্ত পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারার কারণে, পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সময় অতিবাহিত করার সুযোগ খুব বেশি না থাকায়। উচ্চশিক্ষা মানে উচ্চশিক্ষা। এর একচুলও কমের সুযোগ না থাকা। তাই বলে আমরা ছাত্রসংগঠন করিনি, তা মোটেও দাবি করছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল। নিজস্ব জাতীয় দিবস পালন, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করা, নিজেদের ব্যক্তিগত নানা ধরনের সমস্যার সমাধান করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা ইত্যাদি কাজ আমরা সাংগঠনিকভাবেই করেছি। প্রতিবছর সংগঠনের নেতৃত্ব গঠনতন্ত্রভাবেই আমরা নির্বাচিত করেছি। সেই নেতৃত্বের সম্মুখে ক্ষমতা, অর্থবিত্তের কোনো সুযোগ ছিল না, আমরা আশাও করিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সংগঠন থাকবে শুধুই শিক্ষা, সংস্কৃতি, সেবাদান এবং দেশ, স্বাধীনতা ইত্যাদিকে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে বোঝার উদ্দেশ্যে, সে ধরনের আয়োজন থাকবে শিক্ষাঙ্গনে। ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াবিষয়ক প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে, জ্ঞানচর্চার উদাহরণ তৈরি করতে পারে। এর বেশি কিছু করার সুযোগ তাদের কক্ষচ্যুত করবেই—এতে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়।
অন্যদিকে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে আদতেই বদলে দিতে হবে। মানহীন কলেজ-মাদরাসা, বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবেই। লেখাপড়ার সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক নেই—এমন শিক্ষার্থীর হাতে সনদ তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতেই হবে। উচ্চশিক্ষা লাভের বিষয়টি যেন মানহীনভাবে উতরে না যেতে পারে, গবেষণা ও মানসম্মত জ্ঞানলাভে যেন কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকে, সেটাই নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পৃথিবীর অন্যতম পিছিয়ে পড়া অবস্থানে চলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষাকে আমরা মানহীনভাবে চলতে দিয়েছি প্রায় চার দশক ধরে। সে কারণে বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না, বিদেশ থেকে লাখ লাখ দক্ষ জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে, কোটি কোটি তরুণ-তরুণী মানহীন শিক্ষা সনদ নিয়ে বেকার জীবন অথবা প্রত্যাশিত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না। রাজনীতিতেও তথাকথিত ‘ছাত্ররাজনীতি’র নেতারা যোগ্যতার কোনো প্রমাণ দিতে পারছে না। রাজনীতিতে লেখাপড়া জানা দক্ষ-বিশেষজ্ঞ মানুষের বড়ই প্রয়োজন। সেটি বর্তমান ‘ছাত্ররাজনীতি’ ছাত্রসংগঠন থেকে আশা করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। শিক্ষাজীবনে সবাইকে যথার্থ শিক্ষার্থীরূপে ক্লাস, লাইব্রেরি, গবেষণাগার ও পাঠ্যক্রমে থাকতে দিন, সেই প্রক্রিয়া ও পরীক্ষায় তাদের উত্তীর্ণ হতে দিন। তা না করেই ‘নেতা’ শব্দটি তাদের মনোজগেক কতটা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করে তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। ছাত্ররাজনীতির কুহেলিকায় আচ্ছন্ন অসংখ্য তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী নিজেদের মেধার বিকাশ না ঘটিয়ে যেভাবে সময় অতিবাহিত করে, তাতে তারা বড়জোর একজন দোকানি, টেন্ডারবাজ বা অবৈধ পথে অর্থবিত্তের সুযোগসন্ধানী হতে পারে, দেশ ও জাতির একজন উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ও দক্ষ মানবসম্পদরূপে পরিণত হতে পারবে না। একটি ভয়ংকর সর্বনাশা শিক্ষা ও রাজনীতির মিশেলে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস হওয়ার পথেই যেতে দিচ্ছি। অথচ তারা যদি মেধাচর্চার শিক্ষা পেত, তাহলে অসংখ্য জ্ঞানী, গুণী, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষ নেতাও আমরা পাওয়ার সুযোগ পেতাম। ৭০-৮০ বছরের ধ্যান-ধারণায় নয়, একুশ শতকের বাস্তবতায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, ছাত্রসংগঠন, ছাত্ররাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতি ও জীবনকে দেখতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ