দেশের শিশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসা ক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক, চিকিৎসা-শিল্প উদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কার মনষ্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান (১৯২৮-১৯১৭) এম আর খান হিসেবে ছিলেন অতি পরিচিত। আজ ১ আগস্ট তার ৯২তম জন্মবার্ষিকী। শুক্রবার (২ আগস্ট) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।
ডা. এম আর খানের মরহুম পিতা আবদুল বারী খান সমাজহিতৈষী সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন সাতক্ষীরায়। ব্যক্তিত্বে, বদান্যতায় বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। অখ্যাত পল্লীর প্রান্তরে মহীরুহের মতো ছিল তার সামাজিক অবস্থান। শিক্ষিত সজ্জন এই সমাজপতি নিজের সন্তানদের সুশিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ সজাগ। সাতক্ষীরা ধন-ধান্যে মাৎস্যে মাতোয়ারা সেই সনাতন কাল থেকেই। এম আর খানের প্রিয় ছড়ায় যেমনটি ফুটে উঠেছে।
দেশের সীমানা, নদীর ঠিকানা যেথায় গিয়েছে হারিয়ে,
সেথা সাতক্ষীরা, রূপময় ঘেরা বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।
এম আর খানের বাবা বারী খান এবং মাতা জায়েরা খানম ছিলেন সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষাদানের ক্ষেত্রে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট যত্নবান। তারা তাদের বড় সন্তান শফী খানকে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াতে পাঠিয়েছিলেন, আর এম আর খানকে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে ও পরে কলকাতা মেডিকেল কলেজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে তাদের দৃঢ়চিত্ততা ও অমোঘ প্রত্যয়ে ছিল না কোন দ্বিধা ও দৈন্যতা। আর সে সুবাদে আজকের বাংলাদেশ ও জাতি পেয়েছিল সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য এক চিকিৎসক, সমাজসেবক ও সৃজনশীল কর্মবীরকে। যিনি শুধু সাতক্ষীরার জন্য গৌরব নন, দেশের জন্য সাতক্ষীরারও সগৌরব নিবেদন।
ডা. এম আর খান সাতক্ষীরার সব মানুষের অভিভাবক ছিলেন খোদ এই রাজধানী শহরেও। সদাহাস্য এই কর্মবীর প্রতিটি শিশুরোগীর জন্য যেমন অকৃত্রিম বন্ধু; সাতক্ষীরা প্রবাসীদেরও তেমন আশা-ভরসার স্থল। ঢাকার সাতক্ষীরা জনসমিতির শৈশব আর কৈশোর কাল পেরিয়ে যৌবনকালে প্রাপ্ত সাংগঠনিক ‘ঠিকানা’ বিনির্মাণে তার নেতৃত্ব ও অবদান অব্যয় অক্ষয় অবয়বে থাকবে চিরকাল। আমরা যারা তার অনুরক্ত ভক্ত যখনই ফোনে কিংবা হাতে চিরকুট দিয়ে শিশুরোগীকে তার কাছে পাঠিয়েছি তাকে তৎক্ষণাৎ অতি আপনার মনে করে দিয়েছেন চিকিৎসা। সেই সব শিশুরোগীরা আর তাদের অভিভাবকের দোয়া ও কৃতজ্ঞতায় ডা. এম আর খান আজীবন আত্মিক উৎকর্ষতা অর্জন করেছিলেন। ‘উপকার কর এবং উপকৃত হও’ এই মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন ও মেধায় পথচলা ও জীবন সাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ এবং কার্যকর ছিল। আর এসবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মতো সারল্যে, সহজিয়া কড়চায়, বন্ধু বাৎসল্যে, স্নেহাস্পদনায়, মুরুব্বিয়ানার মাধুর্যে তার ব্যক্তি ও চরিত্র উদ্ভাসিত।
সাতক্ষীরায় নিজের গ্রাম রসুলপুরকে আদর্শগ্রাম তথা দারিদ্রমুক্ত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার স্বপ্ন উদ্যোগ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে দিক-দর্শন হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। ‘নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি’ এই প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সকল সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সুদূর পরাহত থাকে না আর। ‘রসুলপুর আদর্শগ্রাম’ এই মডেলে গড়ে উঠুক বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রাম ও জনপদ এ ছিল তার প্রত্যাশা। পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মযজ্ঞে রসুলপুর যেন পল্লী উন্নয়নে সমৃদ্ধ চেতনার নাম। সবাইকে বলতেন প্রত্যেককে নিজের গ্রামের উন্নতিতে অবদান রাখতে। তাহলে বাংলাদেশ উন্নত হবে।
শিশুবন্ধু এম আর খানের জীবন দর্শন ছিল-কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানব কল্যাণে নিবেদিত চিত্ততা। নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশু চিকিৎসা সদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নেরা ডানা মেলে ফিরেছে সাফল্যের আকাশে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু, নারী ও অসহায়জনের নতশির, মূক ও ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে সাফল্যের তারকারা ঝিলিমিলি করে তার ললাটে, তার মুখে-তার সানন্দ তৃপ্তির নিলয়ে। জোনাকির আলো যেমন অমানিশার আঁধারে মিটি মিটি জ্বলে এক অভূতপূর্ব পেলব শান্তি ও সোহাগের পরিবেশ রচনা করে, তেমনি তার সুদক্ষ পরিচালনায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, নৈপুণ্যে, নিবেদনে অর্থবহ অবয়ব রচনা করে চলেছে নিত্যনিয়ত। এসবের মাঝে চির ভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান মনে করতেন, রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সমাজে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়স্বজন এমনকি আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্য প্রার্থী, কখনও কখনও অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তা হলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করা প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারও কারও সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহতায়ালা; তেমনি রোগ হতে মুক্তিদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন যে ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
মহৎপ্রাণ মানুষেরা নিজের জন্য নয় অন্যের কল্যাণে নিবেদন করেন নিজের সব ধন ও ধ্যান-ধারণাকে। উৎসর্গ করেন নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে। এম আর খান আনোয়ারা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড এমন এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের সঞ্চয়, সম্পদ ও সামর্থ্য। নিজের একমাত্র কন্যাসন্তান কানাডায় প্রবাসী এবং ২০১১ সালে স্ত্রী আনোয়ারা খানের মৃত্যুর পর নিজের জন্য পরিবারের জন্য যেন তার আর ছিল না কোন পিছুটান। তাই একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে চলেছেন দিক-নির্দেশনায়। তার একান্ত প্রত্যাশা ছিল স্থায়িত্ব লাভ করুক জনদরদী এ ফান্ড ও প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরা তথা দেশের মানুষ পাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ জীবনযাপনের দিশা। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখেছিলেন, শিখেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছেন মানুষের অসহায়ত্বকে সহায় হয়ে দাঁড়াবার অনিবার্যতা। ‘দুর্বল মানুষ যদি পার হয় জীবনের অথৈ নদী’ তাতে নিজের কোন ক্ষতি নেই বরং বিপদমুক্ত মানুষের কলরবে সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি। কেন তাই এ পথে পিছিয়ে যাব? রেখেছেন এ প্রশ্ন নিজের কাছে, দেশের কাছে।
শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তা তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে এ সুযোগ লাভ তার অধিকার। ডা. এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উঁচু মাপের চাকরির সুযোগ ও সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছেন পথিকৃতের ভূমিকায়। সদাশয় সরকার তার এ মহৎ অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদবিতে ভূষিত করেছে এবং তার পরিকল্পনায় ও প্রযত্নে শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দিয়েছিলেন সক্রিয় ও সার্বিক সহযোগিতা। তার মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কারণেই এ দেশে শিশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা সম্ভব হয়েছিল। তিনি শেরেবাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক (১৯৯২); কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় স্বর্ণপদক (১৯৯৩); কবি সরোজিনী নাইডু স্মৃতি পরিষদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭); খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা স্বর্ণপদক (১৯৯৮); বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমাজসেবা স্বর্ণপদক (১৯৯৯); ইবনে সিনা স্বর্ণপদক (১৯৯৯); নবাব সলিমুল্লাহ পুরস্কার (২০০৬) একুশে পদক (২০০৯) এবং স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন।
কর্মজীবনে ডা. এম আর খান দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তারপর দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।
১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগদান করেন এবং এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ডা. খান ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে পুনরায় তিনি বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তার সুদীর্ঘ চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান