দেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে খ্যাত ডাকসু নির্বাচন সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত শতাব্দীতে! ১৯৮৯ সালে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের পর ২৭ বছর কেটে গেছে; অথচ এই দীর্ঘ সময়ে পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি। এই অনাগ্রহের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না। ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কথা বলে আসছে। অবশ্য তাদের এ দাবি খুব জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়নি এতদিন। কিন্তু সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোরালোভাবে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনায় ডাকসু নির্বাচন দাবির আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ডাকসুর এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান তো সংঘটিত হয়েছিল ডাকসুর নেতৃত্বেই। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ডাকসুর ভিপি হিসেবেই আসম রব সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দ্বিতীয় কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাত-সংঘর্ষসহ বিভিন্ন অপঘটনা যখন প্রত্যক্ষ করি আমরা, তখন ডাকসু নির্বাচনের অপরিহার্যতার কথা আরও বেশি গুরুত্ব পায়। ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকার কারণেই কোনো বিশেষ সংকটের সমাধানে বৈধ কর্তৃপক্ষ পাওয়া যায় না এবং তাই সংকটের সমাধান তো হয়ই না; বরং তা কখনও কখনও ঘনীভূত হয়। ছাত্র সমাজের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য হলেও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির আবশ্যকতা রয়েছে। ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করবে কারা? প্রতিটি ছাত্র সংগঠনই যদি এই নেতৃত্ব দিতে উদ্যোগী হয়, সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বৈকি।
আমরা ছাত্র রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছি অথচ সেই রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা চাই না- এ এক বড় প্যারাডক্স। এমন যদি হতো, ছাত্র রাজনীতিরই প্রয়োজন নেই, তাহলেও একটা কথা থাকত। রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ চলতি বছরেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন হতেই হবে। এই নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে। যথার্থই বলেছেন তিনি। ডাকসুকে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাপ্লাই লাইন বলা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উঠে এসেছে আমাদের রাজনীতিক সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনরা। তাই আমরা বলব, অবিলম্বেই ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। ২৭ বছর ধরে আমরা শুধু প্রতিশ্রুতিই শুনে এসেছি। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের উদ্যোগ কেউই নেননি। এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবে ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর নির্বাচিত যোগ্য ও বৈধ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর