ডাকসু নির্বাচনের স্মৃতি - দৈনিকশিক্ষা

ডাকসু নির্বাচনের স্মৃতি

বিমল সরকার |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি সরাসরি মোট এক-দেড় বছর শিক্ষালাভ করি। অনার্স পাস করার পর আনন্দমোহন কলেজেই মাস্টার্স শেষপর্ব পড়ার ব্যবস্থা থাকলেও মনে প্রবল আগ্রহ জাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কলেজ থেকে ছাড়পত্র বা অনুমতিপত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

একদিক থেকে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে, মাত্র এক বা দেড় বছরের অধ্যয়নকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এমন দু-একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছি, যা টানা চার-পাঁচ বছর কিংবা এরও বেশি সময় অধ্যয়ন করেও অনেকের জীবনে আসে না।

এমনই একটি বিষয় ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন। স্বাধীনতা লাভের প্রথম ১০ বছরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মোট চারবার। ১৯৮২ সালের ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চতুর্থ ডাকসু ও জগন্নাথ হল সংসদ নির্বাচনে আমি নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করায় বেশ গর্ববোধ করি। আমার মতো ব্যক্তির জন্য এ এক বিরল সুযোগ। আমার স্মৃতিপটে এটি এখনও অম্লান হয়ে আছে।

সেই দিনটির কথা খুবই মনে পড়ে। ১৯৮১ সালের নভেম্বর অথবা ডিসেম্বর মাস হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কলাভবনে গিয়ে দেখি গম গম অবস্থা। সামনেই ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচন উপলক্ষে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যার যার সংগঠন নিয়ে।

ভর্তির সময় জগন্নাথ হলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলেও নিজের নামে সিট বরাদ্দ পেতে আমাকে তিন-চার মাস অপেক্ষা করতে হয়। স্পষ্ট মনে আছে, জগন্নাথ হলে প্রথম রাতটি কাটিয়েছিলাম বর্তমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিলের সিটে।

অ্যাসেম্বলি ভবনের (বর্তমান অক্টোবর স্মৃতি ভবন) দ্বিতীয়তলার একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। অসীম উকিল তখন কিশোরগঞ্জের খ্যাতনামা সাহসী ছাত্রনেতা। ডাকসু কার্যকরী কমিটির সদস্য।

এ কক্ষে একটি রাতই আমার থাকা। পরে অন্যত্র ব্যবস্থা হয়। কক্ষটিতে রাত ১০টার দিকে যখন ঘুমাতে দেয়া হয় তখন আমি একা। সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি উপরে ও নিচে এলোপাতাড়ি সাত-আটজন বেঘোর ঘুমাচ্ছেন।

পরে জানলাম, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং আসন্ন ডাকসু নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নেতাকর্মীরা গভীর রাত পর্যন্ত জাগা ছিলেন। অসীম উকিল নিজেও জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ (জালাল-জাহাঙ্গীর) মনোনীত প্যানেলে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

আমাদের ক্লাস পুরোদমে তখনও শুরু হয়নি। মাঝে ময়মনসিংহে কয়েকটি দিন কাটিয়ে আবার হলে ফিরে আসি। এবার দেখি জমজমাট অবস্থা। ডাকসু ও ১১টি হল সংসদ নির্বাচনের তারিখ ও তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন নতুন করে জেগে উঠেছে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার বিভেদ-বিভক্তি এর আগে কখনও বোধকরি এমন জটিল রূপ ধারণ করেনি। শুধু ‘ছাত্রলীগ’ নামেই অন্তত চার-পাঁচটি প্যানেল এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তবুও সবকিছু মিলে উৎসবের, বলা যায় একেবারে মহোৎসবের আমেজ।

একেকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ডাকসু ও বিভিন্ন হল সংসদে প্যানেল বা প্রার্থীদের নাম ঘোষণা, পরিচিতি সভা, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, মিছিল, স্লোগান- বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে যেন এক মহাযজ্ঞের আয়োজন।

প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু আর গভীর রাত অবধি সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সমর্থক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কর্মতৎপরতা ও পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখর হয়ে ওঠে। সর্বত্রই প্রাণচাঞ্চল্য। অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী ছাত্রনেতাদেরও ক্যাম্পাসে আনাগোনা শুরু হয়।

ডাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্যানেলগুলোর পৃথক পৃথক পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয় দিনের বেলায় বটতলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। আর হলগুলোতে রাতে। মিছিল, স্লোগান, করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ঘোষিত প্রার্থীদের পরিচিতি সভার সময় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ শত শত উৎসুক সাধারণ শিক্ষার্থী, এমনকি বিভাগের সবচেয়ে মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্রটিও চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করছেন।

অনেকে তো সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই অবতীর্ণ হন নির্বাচনী এ মহারণে। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই হোক তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বা এখনও করছেন।

তাদের মধ্যে আক্তারুজ্জামান (ভিপি), জিয়াউদ্দিন বাবলু (জিএস), ওবায়দুল কাদের, বাহালুল মজনুন চুন্নু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মুজিবুল হক চুন্নু, গোলাম সারওয়ার মিলন- কাকে রেখে কার নাম বলব।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য সময় ও সুযোগ বুঝে দলবদলও করেছেন কেউ কেউ। অর্থনীতি বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র বলে পরিচিত আমার প্রিয় আকাশ ভাইও (মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ) ডাকসুর সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলভুক্ত জিএস প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

অধ্যাপক ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী তখন উপাচার্য এবং আমাদের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন। দু’জনের কেউই আজ বেঁচে নেই। নির্দিষ্ট দিনে উৎসবমুখর পরিবেশে বেশ ভালোয় ভালোয় শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ডাকসু এবং ১১টি হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেয়া মানে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। নির্বাচনের ফলাফল- ডাকসুতে সাধারণ সদস্যসহ ১৯টি পদের মধ্যে ছাত্রলীগ (আক্তার-বাবলু) ভিপি ও জিএসসহ ১২টি পদে জয়ী হয়। ছাত্রদল জয়ী হয় এজিএসসহ চারটিতে।

বাকি তিনটি পদের মধ্যে দুটি পায় ছাত্রলীগ (জালাল-জাহাঙ্গীর) ও একটি ইসলামী ছাত্রশিবির। ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন যথাক্রমে আক্তারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন বাবলু। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আক্তারুজ্জামান এর আগে দ্বিতীয় (১৯৭৯) ও তৃতীয় (১৯৮০) ডাকসুর জিএস এবং জিয়াউদ্দিন বাবলু তৃতীয় ডাকসুর এজিএসের দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানত সাংগঠনিক বিভেদ-বিভক্তির কারণে আজকের তারকা-রাজনীতিক বলে পরিচিত অনেকেই এ নির্বাচনে ধরাশায়ী হন।

হল সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে একমাত্র জগন্নাথ হল ছাড়া ছাত্রদলের বলতে গেলে জয়জয়কার অবস্থা। ১১টি হলে ভিপি ও জিএসসহ ১৩২টি পদের মধ্যে ৬৫টিতেই জয়ী হয় ছাত্রদল। বাকিগুলোতে চার-পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রশিবির ও অন্যরা জয়ী হয়।

জগন্নাথ হলে ভিপি ও জিএসসহ ১২টি পদের সব কটিই করায়ত্ত করে ছাত্র ইউনিয়ন। এখানে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন যথাক্রমে হিরণ্ময় পাণ্ডে (প্রয়াত) এবং রঞ্জন কর্মকার।

নির্বাচনের ৫৩ দিন পর ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর নবনির্বাচিত কর্মকর্তাদের অভিষেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান করেন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী।

ঋতুরাজ বসন্তের পড়ন্ত বিকালে নেতাকর্মী ও সমর্থক এবং অগণিত তরুণ-তরুণী সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এ আনন্দঘন অনুষ্ঠান সন্ধ্যা অবধি উপভোগ করি।

সরকার যায়, সরকার আসে। উপাচার্য বিদায় হন, নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেন। কিন্তু ডাকসু এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সবাই প্রায় নীরব। এক সময়কার তরুণ-তরুণীরা আজ প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। বর্তমান প্রজন্মের লাখ লাখ শিক্ষার্থী কেবল নিজেদের অধিকার থেকে নয়, বঞ্চিত রয়েছে এক ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ থেকেও।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক

সূত্র : যুগান্তর

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004417896270752