দূষণ কত প্রকার ও কি কি তা জানতে হলে, বুঝতে হলে এবং তার চিরায়ত রূপ দেখতে হলে, বাস করতে হবে বাংলাদেশে। তবে সবখানে নয়, থাকতে হবে ঢাকা বা চট্টগ্রাম নগরীতে অথবা নিদেনপক্ষে ঘন জনবসতিপূর্ণ অন্য কোনো শহরে— যেখানে রয়েছে বাস-ট্রাকের মাথা গরম করা হাইড্রলিক হর্নের শব্দ, রিকশার খটাং খটাং আওয়াজ, তিন চাকাওয়ালা গাড়ির কর্ণবিদীর্ণকারী শব্দসহ ভুস্ভুস্ করে ছেড়ে দেওয়া কার্বনভরা বিষাক্ত ধোঁয়া, ধূলায় ধূসরিত ধোঁয়াশা আকাশ, ‘হূদয়হরণ-করা’ নর্দমার গন্ধ, রাস্তার পাশে দিনের পর দিন জমে থাকা আবর্জনার স্তূপের উত্কট রূপ, কল-কারখানা থেকে নির্গত যেখানে-খুশি-সেখানে-চলমান বর্জ্যের তরল প্রবাহ ইত্যাদি ইত্যাদি।
দূষণ বিষয়টা শুধু জটিলই নয়, এটি বহুরূপী। এটি থাকে শব্দে, বায়ুতে, পানিতে, মাটিতে আর আলোতে। দূষণ জন্ম নেয় আবাসিক বাড়ি-ঘর, কল-কারখানার বর্জ্য-আবর্জনায়, প্লাস্টিকে, জীবাশ্ম জ্বালানিতে (তেল, গ্যাস, কয়লা), কল-কারখানা, ইটভাটার নির্গত গ্যাসে, বিষাক্ত পদার্থে, রাসায়নিক সার আর কীটনাশকে, স্টীমার-লঞ্চের ভেঁপুতে, এমনকি ঘরের এসিতে আর চলমান পাখাতে।
শুরুটা করতে চাই শব্দদূষণ দিয়ে। শব্দদূষণ সৃষ্টি হয় উচ্চ শব্দের কারণে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু আর সন্তানসম্ভবা মায়েরা। উচ্চ আওয়াজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমনকি মায়ের পেটে থাকা বাচ্চাও। রাস্তায় গাড়ির কান ঝালাপালা করা বিকট শব্দ রক্তচাপ আর হূদকম্পন বাড়িয়ে দিয়ে, মাংসপেশি সংকুচিত করে, শিরা আর স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে শিশু-কিশোরদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিচ্ছে; ক্রমান্বয়ে ঠেলে দিচ্ছে বধিরতার পথে। শুধু কি শিশু-কিশোর? বড়দেরও নিস্তার নেই।
ট্রাফিক পুলিশরা তো বেঁচে আছেন আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে। বধির তো তারা হয়েই যাচ্ছেন, বুড়ো হওয়ার আগেই। ধীরে ধীরে সবার অজান্তে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ দূষণের কবলে ঢাকাসহ সারা দেশ। ঢাকায় শব্দদূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি। শব্দদূষণ শুধু একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যাই নয়, এটি নীরবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে নাগরিকদের। ধীরে ধীরে তারা হারাচ্ছে শ্রবণশক্তি, আক্রান্ত হচ্ছে শিরপীড়া, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অসুস্থতা, স্নায়ুবিক বৈকল্য, হূদরোগ আর নিদ্রাহীনতায়। মেজাজ তো খিটখিটে হচ্ছেই। মনুষ্যসৃষ্ট সন্ত্রাসের মতো শব্দদূষণও এক প্রকারের সন্ত্রাস। জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে শব্দসন্ত্রাস অন্যান্য সন্ত্রাসের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়।
আমরা অনেকে জানিই না যে, শব্দদূষণ শুধু গাড়ি বা কল-কারখানার কারণেই হয় না, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর শব্দ নির্গত হয় আমাদের ঘরের ভেতর থেকেও। বদ্ধ ঘরে অতি শখের পাখা তিনটি পাখনা মেলে ঘূর্ণাবর্তে ছেড়ে দেয় অবিরাম শব্দমণ্ডিত হাওয়া, এয়ারকন্ডিশনার হালকা লয়ে তুলে ধরে তার আপন ব্যঞ্জনা, রসের সাথে কানও সিক্ত করে তোলে ব্লেন্ডার আর গ্রাইন্ডার। স্বল্পমাত্রার হলেও এগুলোর শব্দ ক্ষতিকারক। আর বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে তো বাঙালিরা এখন নাচতে নাচতে বিদেশি মিউজিকের প্রচণ্ড শব্দের ঘূর্ণনে গভীর রাত পর্যন্ত আত্মহারা হয়ে আশ-পাশের শিশু-বৃদ্ধ সবার ঘুম কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেউ থামাতে বললে তার উপর হামলা করছে, অকথ্য ভাষা ছুঁড়ে দিয়ে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে মান-সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করছে না।
বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি কাজটি ঠিকমতো করতে না পারেন, তাহলে ব্যর্থতা স্বীকারসহ জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়িত্ব থেকে অবসর নিন এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এতদিন যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন তা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়ে ব্যর্থতার কারণ বিস্তারিত জানিয়ে বিদায় হোন। আপনারা সাড়ম্বরে পালন করেন আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস। এসব করে একটুও কি সচেতন হয়েছেন আপনারা যারা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন?
পাঁচ বছর আগের এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, আমাদের এ দেশটার ২০ শতাংশ মানুষ কানে শোনার শক্তি হারিয়েছে, তার মধ্যে ২৬ শতাংশ শিশু। সময়ের ব্যবধানে অবশ্যই এ সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। কী মারাত্মক দুর্যোগের ভেতরে বসবাস করছি আমরা, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই পাঠক। মনে রাখা দরকার, শব্দ দূষণের মাত্রা ৬০ ডেসিবল হলে যেকোনো মানুষ ক্ষণস্থায়ীভাবে বধির হয়ে যেতে পারে; আর ১০০ ডেসিবল হলে প্রকৃতি আর ক্ষমা করবে না, নির্ঘাত হয়ে যাবে চিরস্থায়ী বধির।
আর ঢাকা শহরে স্থানভেদে শব্দ দূষণের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল পর্যন্ত। একটু চিন্তা করুন সবাই। কোথায় যাচ্ছি আমরা? বধিরতার দিকে, পঙ্গুত্বের দিকে, শারীরিক অক্ষমতার দিকে! শহরের স্কুল/কলেজগামী শিশু-কিশোর-যুবকদের কী হবে! তাদের ভবিষ্যত্ আমরা ছেড়ে দিচ্ছি ওইসব বিবেকহীন মানুষের হাতে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে জেনেশুনে শব্দদূষণ তৈরি করছে আর ওইসব অক্ষম প্রশাসক/কর্মকর্তাদের হাতে যারা শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থেকেও সঠিক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। দেখিনি তবে শুনেছি, বাংলাদেশে এক ‘কঠিন’ আইন রয়েছে। নাম তার শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ২০ ধারার ক্ষমতাবলে ২০০৬ সালে প্রণীত এ বিধিমালা কী কাজে লাগছে? দেখার কেউ নেই।
এ মুহূর্তে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগের সাথে সাথে ব্যাপক জনসচেতনতা। কর্তৃপক্ষ মেহেরবান হলে তারা শব্দ মাপার যন্ত্র ব্যবহার করে রাস্তায় রাস্তায় দেখতে পারেন কোথায় সহনীয় মাত্রার উপরে শব্দ উঠে যাচ্ছে এবং কতক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে। সেমতে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আরেকটি মারাত্মক দূষণ হলো প্লাস্টিক দূষণ। এটি এমন একটি দূষণ যা সবার অজান্তেই ক্ষতি করছে সবার। প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা হয় জীবাশ্ম-জ্বালানি দিয়ে। আর জীবাশ্ম-জ্বালানি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ। এক হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে যত পরিমাণ তেল উত্পাদিত হয় তার আট শতাংশ ব্যবহূত হয় প্লাস্টিক তৈরিতে। প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে নির্গত হয় প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড। সাগর দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক। প্রতি বছর প্রায় ১২.৭ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সাগরে প্রবেশ করে যার চার-পঞ্চমাংশই সাগরে প্রবেশ করে আমাদের বিচরণক্ষেত্র ভূমি থেকে; এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দশম স্থানে।
ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আগামী ৩০বছর পার হতে না হতেই সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ হবে বেশি। জানা যায়, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন দুই কোটি অপচনশীল পলিথিন জমছে যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে জনজীবন দুর্বিষহ করে দিচ্ছে। এগুলো নদীর নাব্য নষ্ট করছে, খাল-নদী-সাগরে পড়ছে আর জলজপ্রাণি সেগুলো গ্রহণ করার ফলে তা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষের শরীরে ঢুকে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। শুধু ঢাকার পাশ চিরে বহমান বুড়িগঙ্গার তলদেশে নাকি আট ফুট উঁচু পলিথিন-বর্জ্যের স্তর জমে আছে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন থাকা সত্ত্বেও মনে হয় জেনেশুনেই কর্তাব্যক্তিরা প্রায় ১২শ কারখানায় পলিথিন তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে।
জানি না কী কারণে বাংলাদেশ ২০০২ সালে বিশ্বে প্রথম প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখন চারদিকে প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি দেখছে। অথচ এ বাংলাদেশকে অনুসরণ করেই ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে মরক্কো ও কেনিয়াসহ অনেক দেশ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি পদার্থ জৈব প্লাস্টিক, অজীবাশ্ম-জ্বালানির তৈরি গ্রাফিনের তৈরি প্লাস্টিক এবং পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে প্লাস্টিক দূষণের অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব, এ বিষয়টা কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন না? প্লাস্টিকের পলোতে আটকা পড়া পরিবেশকে মুক্ত করা আমাদেরই দায়িত্ব।
কম পরিচিত আরেকটি দূষণ হলো আলো দূষণ। আলো দূষণ নিয়ে আলোচনা হয় কম, তবে তুচ্ছ করার মতো বিষয় নয়। অতি উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল আলো রাস্তায় গাড়ি চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি করে। গাড়ি চালকেরা বিশৃঙ্খল আলোর কারণে বিভ্রান্ত হলে দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিলবোর্ডের উজ্জ্বল আলোও চালককে হকচকিয়ে দিতে পারে। পরিবেশবিদরা বলছেন, সঠিকভাবে ব্যবহার না হলে আলো পরিবেশ দূষণেরও কারণ হতে পারে। কৃত্রিম আলোর অতি ব্যবহার বাড়ি-ঘরেও দূষণ ঘটাচ্ছে। অতিবেগুনি রশ্মির মতোই ক্ষতিকর কম্পিউটারের মনিটর, টেলিভিশন সেট আর ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস থেকে নির্গত নানা বর্ণের আলো। টিভি সেট থেকে বিচ্ছুরিত আলো ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষের চোখ, ক্ষয় করে নিউরণ, করে স্মরণশক্তি হ্রাস, সৃষ্টি করে মাথাব্যথা আর জন্ম দেয় দেহবিধ্বংসী আলঝেইমার্স রোগ। কৃত্রিম আলোয় কাজ করা মানুষেরা শিকার হয় শারীরিক অক্ষমতার। তাই যত বেশি প্রাকৃতিক আলো, তত বেশি দেহশান্তি।
তাই সংশ্লিষ্টদেরকে বলি, তোমরা ইটপাথরের বাড়ি বানাও। তবে শহরের সবুজ গাছপালাগুলো কেটো না। মাঠগুলো দখল করে বাড়ি-মার্কেট বানিয়ো না। পুকুর-জলাশয় ভরাট করো না। অপরিকল্পিত নগরায়ন করো না। নদীগুলো দখল করো না। নদী-লেকে-খালে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলো না। নদীগুলোর তলা থেকে বালু-মাটি উত্তোলন করে ওকে বিপন্ন করে দিও না। শহরের খালগুলো ভরাট করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করো না। অনুরোধ করি, তোমরা প্রভাবশালীদেরকে আইনের আওতায় আনো, তাদের ছেড়ে কথা বলো না। নদী-খাল-মাঠ দখলকারীদের রুখে দাঁড়াও।
দেশটাকে বাঁচাও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের হাত থেকে। বেড়িবাঁধ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখো ওরা কীভাবে বুড়িগঙ্গার শরীর থেকে শাড়িটা কেড়ে নিয়েছে; পারবে ওটাকে উদ্ধার করতে? রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে ওরা কিছুই না। ধরো ওদের, শক্ত করে ধরো। রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে ছাড়া পেতে চাইলে আরো মজবুত করে বাঁধো। কামারপাড়ার ব্রিজ থেকে তাকিয়ে দেখো বেচারা তুরাগের দিকে। কাঞ্চন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দেখো শীতলক্ষ্যার দিকে।
মানুষ হলে তোমার দিলটা কেঁদে উঠবে। এগিয়ে আসো। প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে তোমার পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাও। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা ব্যবস্থা নিতে যতই মোচড়ামোচড়ি করি না কেন, প্রকৃতি কিন্তু বসে থাকবে না। সে তার কাজ করেই যাবে আপনমনে। আর প্রকৃতির কাছে পরাজিত আমরা মানুষগুলো পড়ে যাবো স্বখাদ সলিলে। বিপন্ন প্রকৃতিই একদিন আমাদেরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সহসা গ্রহণ না করলে দূষণের শাসনে শাসিত হয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাবে হারিয়ে বিপন্নতার অন্ধকারে।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: ইওেফাক