'না' পাওয়ার বেদনা শিক্ষকদের - Dainikshiksha

'না' পাওয়ার বেদনা শিক্ষকদের

সাব্বির নেওয়াজ |

আট বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এবার আশা করেছিলেন, নির্বাচনের আগে অন্তত নতুন কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। এমপিওভুক্তির দাবিতে নানা সময়ে আন্দোলন করে পুলিশের লাঠিপেটার শিকারও হয়েছিলেন তারা। তবে এমপিওভুক্তির কার্যক্রম এখন স্থবির প্রায়। এতে তারা অনেকটাই নিশ্চিত, আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন এমপিওভুক্তি আর হচ্ছে না। আবার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি, সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ। এ দাবিও পূরণ হয়নি। অন্যদিকে, সরকারি প্রাথমিকের সহকারী ও প্রধান শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে বেতনবৈষম্য। দু'দফায় বড় ধরনের আন্দোলনের পরও প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের মুখে হাসি ফোটেনি। পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের থেকে বেতন কম পান। শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেতে তিন বছরের জায়গায় পাঁচ বছর লাগছে। অর্থ সংকটের কারণে বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার তিন বছর পরেও অবসর সুবিধার টাকা পাচ্ছেন না। জীবনসায়াহ্নে এ অর্থ পেতে হন্যে হয়ে কেবল ঘুরছেন তারা। এতসব 'না' পাওয়ার বেদনা নিয়ে সারাদেশে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে নীরব ক্ষোভ ও হতাশা। 

অবশ্য এমপিওভুক্ত পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বৈশাখী ভাতা ও ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের দাবি পূরণ হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দাবি পূরণের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড, কল্যাণ ট্রাস্টসহ বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য মোট এক হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১০ সালের পরে আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি। অথচ এ সময়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। দুই মাস আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন আহ্বান করে। এ সময় নয় হাজার ৪৯৮টি প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা পড়ে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা প্রাথমিক বাছাই করে দেখেছেন, আবেদনকারী সাড়ে নয় হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বড়জোর দুই হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করে। এর মধ্যে রয়েছে স্কুল-কলেজ প্রায় এক হাজার ২০০, মাদ্রাসা ৫০০ এবং ৩৫০ কারিগরি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো এমপিও পাওয়ার উপযোগী নয়। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে এমপিও দেওয়া হলে বঞ্চিতদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা একদিকে যেমন শিক্ষকদের নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব পালনে প্রভাব ফেলতে পারে, অন্যদিকে নির্বাচনের আগে শিক্ষকদের রাজপথে ঠেলে দিতে পারে। তাই নির্বাচনের  আগে এমপিও না দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে নির্বাচনের আগে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না, তা অনেকটাই নিশ্চিত। 

জানা গেছে, ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল বাস্তবায়ন হলেও সরকারি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষকরা চেয়েছিলেন, সারাদেশের সব বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ হোক। কিন্তু যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি হচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগ ভালোভাবে নেননি বেসরকারি শিক্ষকরা। এজন্য শিক্ষকরা 'এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম' নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এই সংগঠন গত জানুয়ারিতে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট এবং পরে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে। সরকারের তরফে তখন আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। 

এই লিয়াজোঁ ফোরামের মুখপাত্র মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, পরিচালনা পর্ষদের দৌরাত্ম্যে শিক্ষক সমাজ আজ দিশেহারা। কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি। বঞ্চনা আর বেতনবৈষম্যের কারণে মেধাবীরা আজ শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই তারা জাতীয়করণ চান। 

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে একশ্রেণির অশিক্ষিত মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার নিয়েছেন। তারা দলীয় রঙ মেখে শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে থাকেন। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে আমরা চাকরি জাতীয়করণ দাবি করছি। শিক্ষকের আর্থিক সচ্ছলতা, চাকরির নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার জন্যই এ দাবির বাস্তবায়ন দরকার। তিনি বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় এসে বলেছিল, শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে। কিন্তু টাকার অভাবে সেটিও প্রায় না হওয়ার পথে।

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট এক পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ হলেও সরকারের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ যে টাকা খরচ হয়, জাতীয়করণ হলে এর চেয়ে এক হাজার ২২৫ কোটি টাকা বেশি খরচ করতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে, সরকার সমর্থক বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনগুলোর প্রায় ১৪টি দাবি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ, বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, অবসর বয়স ৬৫ বছর করা, প্যাটার্নভুক্ত জনবল কাঠামোর শূন্যপদে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের এমপিও প্রদান, দুটি টাইম স্কেল, শূন্যপদে নিয়োগ, ইনডেক্সধারী শিক্ষক, উচ্চতর স্কেল, উচ্চতর ডিগ্রি, বিএড ডিগ্রি, কামিল পাসের স্কেলসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দেওয়া, সহকারী গ্রন্থাগারিকদের এমপিও দেওয়া, পাহাড়ি এলাকার শিক্ষকদের ৩০ ভাগ পাহাড়ি ভাতা দেওয়া, ২০১০ সালে সর্বশেষ দেওয়া এমপিওপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার বাদ পড়া এক হাজার ৪৪১ জনকে এমপিও দেওয়া, সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণ ইত্যাদি। 

এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষকদের বহু দাবি আছে, যেগুলো যৌক্তিক। সেগুলো পূরণের ব্যাপারে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা চাই শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান দিতে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সরেজমিন যাচাই-বাছাই করা হবে, যেন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানই এমপিও পায়। এতে একটু সময় লাগবেই। শিক্ষকদের অন্যতম বড় দাবি কিন্তু সম্প্রতি পূরণ করা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিয়ে তাদের জন্য পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এবং বৈশাখী ভাতার ঘোষণা এরই মধ্যে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই ইনক্রিমেন্টের জন্য বাড়তি ৫৩১ কোটি ৮২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা লাগবে। বৈশাখী ভাতার জন্য লাগবে ১৭৭ কোটি ২৭ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। নুরুল ইসলাম নাহিদ আরও বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করার পর শিক্ষকরা এসব সুবিধা পেতে শুরু করবেন।

 

সূত্র: দৈনিক সমকাল

তারিখ: ১১ নভেম্বর ২০১৮
 

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041038990020752