নৈতিকতা ও মানবতার কেন এত অবক্ষয়? - দৈনিকশিক্ষা

নৈতিকতা ও মানবতার কেন এত অবক্ষয়?

এ কে এম শহীদুল হক |

একটি ঘটনা গোটা জাতিকে নাড়া দিচ্ছে। ঘটনার নির্মমতা এতই গভীর যে তা শুনে বা জেনে কোনো হৃদয়বান ব্যক্তিরই হৃদয় কেঁপে না উঠে পারে না।  ফেনীতে এক মাদরাসার ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করার চেষ্টা। মেয়েটির অপরাধ সে তার মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করেছিল। তার মা বাদী হয়ে থানায় নারী ও শিশু  নির্যাতন আইনে মামলা করেছিলেন। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা প্রায় ১৮ বছর ধরে ওই মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে আছেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রোকনও ছিলেন।

জানা যায়, তাঁর নানা অপকর্মের কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অধ্যক্ষ তাঁরই মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর প্রস্তাব দেন এবং মেয়েটির গায়েও হাত দেন। মেয়েটি অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে তার সহপাঠীদের জানায়। তার পরিবারকে জানায়। পুলিশ সংবাদ পেয়ে মাদরাসায় যায়। অভিযোগের প্রথমিক তদন্ত করে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কমিটির সদস্য ও এলাকাবাসী দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়। এক দল অধ্যক্ষের বিপক্ষে গিয়ে তাঁর বিচার দাবি করে। আরেক দল তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে তাঁকে নির্দোষ দাবি করে।

৩১ মার্চ ছাত্রীটি পাবলিক পরীক্ষা (কামিল) দেওয়ার জন্য মাদরাসার পরীক্ষাকক্ষে প্রবেশ করে। কোনো এক ছাত্রীকে দিয়ে ডেকে সাইক্লোন শেল্টারের (মাদরাসার প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে) ছাদে নিয়ে যায়। নুসরাতের বক্তব্য মোতাবেক সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত বোরকা, নেকাব ও হাতমোজা পরিহিত চারজন মহিলা ছিল। তাদের একজন তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলা তুলে নিতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা বলে ঘোষণা দিতে চাপ দেয়।

মেয়েটি অস্বীকৃতি জানালে তার হাত ওড়না দিয়ে বেঁধে তার শরীরে কেরোসিন বা দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার চিৎকারে কর্তব্যরত পুলিশ ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নিভিয়ে মুমূূর্ষু অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে পাঠায়। পরে ঢাকা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাকে উন্নত চিকিত্সার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর মতো শারীরিক অবস্থা ছিল না। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মেয়েটি মৃত্যুবরণ করে। গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার গণদাবি ওঠে।

মেয়েদের যৌন হয়রানির অভিযোগ অহরহ পাওয়া যায়। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, গৃহে, কর্মস্থলে, বিদ্যাপীঠে—স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় শিক্ষায়তন, কোথায় নেই। পাঁচ-ছয় বছরের শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ছয় সন্তানের মা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন পাশবিকতা! মানুষ তো আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন, জ্ঞান দিয়েছেন, ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি দিয়েছেন। মানুষ তার জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে খারাপকে পরিত্যাগ করবে এবং ভালোকে প্রতিপালন করবে। কুকর্মের জন্য পরকালে শাস্তি হবে, এটা সব ধর্মেই আছে। ইহকালেও ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিবিধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অন্যের অনিষ্টকারীর জন্য আইনে সাজারও ব্যবস্থা আছে। তবু মানুষ অপরাধ করে থাকে। নৈতিকতার স্খলন ঘটিয়ে মানবতার অনুভূতি ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে চরম জঘন্য ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটায়। সোনাগাজী মাদরাসার ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা এ রকমই একটি জঘন্য, অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনা।

সংঘটিত সব নিষ্ঠুর ও গুরুতর ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে, মামলা নেয়, আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু আদালতের বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে অজানা থেকে যায়। স্বল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এ ধরনের জঘন্য, ঘৃণিত ও স্পর্শকাতর ঘটনা হ্রাস পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দৃশ্য দেখি ভিন্ন। এটা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়।

আমরা জানি শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরা শিক্ষার্থীদের আদর্শ, নৈতিকতা, মানবতা, মানবিকতা, দেশ ও মানবপ্রীতি তথা সুশিক্ষা দেবেন। এটাই তাঁদের মহান কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনের জন্য নিজেদেরই আগে  আদর্শবান হতে হবে। মডেল হতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাঁদের অনুসরণ ও অনুকরণ করে। এখানেই শিক্ষকদের গর্বের জায়গা। অহংকারের জায়গা। কিন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। উচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এ অভিযোগের বাইরে নয়। বিচারের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হয়। এ লজ্জা কিভাবে ঢেকে রাখা যায়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।

আমরা জানি মানুষের মধ্যে ছয়টি রিপু আছে, যা তার খারাপ প্রকৃতিকে সক্রিয় রাখতে চায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে তিনটি প্রবণতা জন্মগতভাবে তৈরি হয়; ইড, ইগো ও সুপারইগো। ইগোর প্রভাবে এক ব্যক্তি একজন ভারসাম্যসম্পন্ন মানুষ হয়। সুপারইগো একজন ব্যক্তিকে অতিমানবীয় গুণাবলি দান করতে পারে। ইডের প্রভাবে কোনো ব্যক্তি অমানুষ হয়ে যেতে পারে। ইডের প্রভাব বেশি হলে সে যেকোনো অপরাধ বা জঘন্য কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আইন-কানুন, পাপ-অপরাধ বোধ তার থাকে না।

সে বিবেকবর্জিত ও বিকৃত রুচির একজন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়। পাপ ও অপরাধ করতে তার বিবেকে বাধে না, ভয়ও হয় না। তাইতো দেখি সুবর্ণচরের একটি গণধর্ষণের সব আসামির বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও তিন মাসের মাথায় আবারও ছয় সন্তানের জননী গণধর্ষণের শিকার হলো। ইডকে দমন করে ইগোর প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা, স্বশিক্ষা এবং সুশীলতার চর্চা। একই সঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের বিকৃত রুচির অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক ত্বরিত শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া। নৈতিকতা অবক্ষয়ের ঘটনা ও নৈতিকতার স্খলনজনিত অপরাধকে কঠোর আইনের আওতায়  আনার পাশাপাশি অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট ও ঘৃণার পাত্র হিসেবে গণ্য করাও অপরিহার্য।

সমাজের নানাবিধ সামাজিক অসংগতি, সামাজিক ব্যাধি ও প্রতিকূলতা দূর করে একটি সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সুশীল ও সুশাসনভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা বাদে এ ধরনের অনৈতিক ও অমানবিক ঘটনার হ্রাস করা কঠিন। গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষণীয়, মাদরাসার ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা যারা করেছে তারা কিন্তু নারী। ভিকটিম নিজেই এ বক্তব্য দিয়েছে। ওই নারীরা (পুরুষও থাকতে পারে) ইসলামী পোশাক তথা পর্দা পরিধান করে মেয়েটিকে অগ্নিসংযোগে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এটা নারী সম্প্রদায়ের মানবিকতার চরম অবক্ষয়।

এ ক্ষেত্রে  নারী জাতির স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রেম, ভালোবাসা, কোমলতা, নমনীয়তা, উদারতা, সহিষ্ণুতার ও মায়াবী মনের  অপমৃত্যু হয়েছে। এটা শুধু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়ই নয়, এটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। স্বশিক্ষা, সুশিক্ষা ও সুশীলতা চর্চার অভাব, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং এক শ্রেণির লোকের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার কারণে এ ধরনের নৈতিকতা ও মানবতার চরম অবক্ষয় ও নানাবিধ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

একটি সমাজের নৈতিকতা ও সুশীলতা পালন করতে হলে সমাজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর চর্চা করতে হবে। পরিবার হবে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও সুশীলতা চর্চার প্রাথমিক ও প্রধান কেন্দ্র। শিশুদের নীতিবান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের সব সময় সুশিক্ষা দিতে হবে। তাদের স্বশিক্ষিত হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাদের আচার-আচরণে ভদ্রতা, নম্রতা, শালীনতা ও সভ্যতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তারা যাতে সুন্দর মনের হয়, গঠনমূলক চিন্তা করে এবং তাদের মননে লিঙ্গভেদে সব ব্যক্তির প্রতি যাতে সমান শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয় সে লক্ষ্যে তাদের গড়ে তুলতে হবে।

সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে অধিষ্ঠিত নেতৃস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সততা, সুশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা ও সৎ চরিত্রের রোল মডেল হতে হবে। এ লক্ষ্যে বড়দের, শিক্ষকদের, তথা সমাজের দায়িত্বশীল সবার আন্তরিকভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র, প্রশাসন সর্বত্র সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

নীতিবর্জিত ব্যক্তিদের সমাজ বা প্রতিষ্ঠান সমর্থন দেবে না। তাদের পক্ষ অবলম্বন করবে না। পরিতাপের বিষয়, মাদরাসার শিক্ষক সিরাজ উদ দৌলার নৈতিকতা স্খলনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এক শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকাবাসী তাঁর পক্ষ অবলম্বন করেছে। একজন বিতর্কিত ব্যক্তি দীর্ঘদিন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটির কি কোনো দায় নেই? তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়।

 

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072629451751709