পরীক্ষা, প্রশ্নফাঁস ও করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষা, প্রশ্নফাঁস ও করণীয়

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
অর্জিত জ্ঞান ও মেধা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষার বিকল্প কিছু নেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শিক্ষায় পরীক্ষা বিদ্যমান। সময়োপযোগি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবাই তাদের শিক্ষাকে বিশ্ব মানে উন্নীত করতে সচেষ্ট। আর আমরা ? আমরা দল বেঁধে জিপিএ-ফাইভ অর্জনের এক অশুভ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। আমাদের পরীক্ষা শত ভাগ পাস এনে দিচ্ছে কিন্তু আসল অর্জন আমাদের কিছুই নেই।  তাই আমাদের গোটা পরীক্ষা তো বটে ,  শিক্ষা ব্যবস্থাই আজ ভেঙ্গে পড়তে বসেছে। আমাদের পরীক্ষা নিয়ে নানা বিতর্ক এখন। একটা সময় নকলের সয়লাবে ভেসে যেত পরীক্ষা। ইদানিং অবশ্য নকল আর তেমন একটা নেই। এমন ও দিন গেছে যে পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশের নকল কুড়িয়ে কয়েক বস্তা কাগজ পাওয়া যেত। গত শতকের শেষ দু' দশক আর চলতি শতকের সুচনার দশকে আমদের নকলের দুর্নাম বয়ে বেড়াতে হয়েছে। নকলে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠেছিলাম।
 
পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির সুবাদে নকলের দুর্নাম অনেকটাই ঘুচানো গেছে। কিন্তু, এখন পেয়ে বসেছে অন্য রোগে। প্রশ্নফাঁসের দুর্নাম আমাদের অক্টোপাসের ন্যায় আকঁড়ে ধরে বসে আছে। এটি আমাদের জাতির গলায় ফাঁসের ন্যায় পেঁচিয়ে বসতে শুরু করেছে । ছোট থেকে বড়- প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ধারাবাহিক ভাবে ফাঁস হচ্ছে । বিশেষ করে গত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের যে নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে আমাদের মান সম্মান একেবারে প্লাস্টিক। এখন প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের জুড়ি নেই। এ থেকে পরিত্রাণ কিংবা উত্তরণের পথ খুঁজে বের না করলে আমাদের জাতিটাকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়বে।  
 
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি গোটা জাতির বড় এক মাথা ব্যথা। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা মিডিয়ায় বিস্তর মাতামাতি। নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ এ জন্য সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিকে দায়ী করছেন।  সিকিউ'র (CQ) চেয়ে এমসিকিউ-কে (MCQ) দোষ দিচ্ছেন বেশী। আসলে সব ভাল জিনিসের কিছু না কিছু খারাপ দিক থাকে। আর আমাদের দোষ এইযে, আমরা কোন কিছুর ভালো দিকের চেয়ে এর খারাপ দিকটাকে বড় করে দেখি।  সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির যে যত বিপক্ষে বলি না কেন, প্রকৃত পক্ষে এটি নিঃসন্দেহে এক অতি উত্তম পদ্ধতি। পৃথিবীর যে সকল দেশ শিক্ষা দীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সকলেই সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণ করে তা করেছে।  এর যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে আমরা ও এর সুফল আরো আগে ঘরে তুলতে পারতাম। MCQ-তে কিছু অসুবিধা আছে বটে। কিন্তু এর জন্য তা উঠিয়ে দেবার চিন্তা করা ঠিক হবে না। এ থেকে জ্ঞানমুলক প্রশ্ন বাদ দিয়ে অন্তত সীমিত আকারের  হলেও ১০ নম্বরের  অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন রাখা দরকার।
 
আরেকটা বিষয় আমার বোধগম্য হতে একটু কষ্ট লাগে। সেটি হলো শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান কিংবা মেধা যাচাইয়ের জন্য ১০০ নম্বরের তিন ঘন্টার এত লম্বা সময়ের পরীক্ষা নিতে হবে কেন ? ২০ কিংবা ৩০ নম্বরের এক ঘন্টার একটি পরীক্ষা নিয়ে একজন শিক্ষার্থীর যে কোন বিষয়ের অর্জিত জ্ঞানের মুল্যায়ন করা কঠিন কোন ব্যাপার নহে। আর বিষয়ের বহর কমিয়ে আনলে এমন কী ক্ষতি ?  জেএসসি'র মত একটা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপুর্ণ পরীক্ষায় ১৪ টি বিষয়ের পরীক্ষা নেবার কোন মানে হয় না। শিক্ষাবোর্ডের লোকজন এতগুলো পরীক্ষা আর এতগুলো বিষয়ের সামাল দেবেনই বা কী করে ? প্রশ্ন ওঠানো থেকে শুরু করে তা শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত  কত হাত যে ছুঁয়ে যায় তা একমাত্র আল্লাহই জানেন । তাতে প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে যায় কোথা ?  
 
এক সময় পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা কোনটাই ছিল না। এখন এ গুলো বাদ দিলে এমন কী ক্ষতি ? ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেবার চেয়ে পরীক্ষা বাদ দেয়াই ভাল। পরীক্ষা ও পরীক্ষার বিষয়ের বহর কমিয়ে উত্তম পরীক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সেটিই ভালো নয় কী ? 
 
আমরা নকল বন্ধ করতে সফল হয়েছি । তাহলে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া বন্ধ করতে পারবো না কেন ? প্রশ্ন ফাঁসকারীদের কাছে গোটা জাতি জিম্মি হতে পারেনা। নোট গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের কাছে আমরা বার বার হেরে যাচ্ছি বলে মনে হয়।  এ সব বন্ধ করতে বাঁধা কোথায় ?  যারা নোট গাইড ও কোচিং বাণিজ্য করে কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে,  জাতিকে বাঁচাতে প্রয়োজনে এদের ক্রস ফায়ার কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মেরে ফেলা উচিত। অন্যথায় পুরো জাতিটাই একদিন মরে যেতে বাধ্য হবে।
 
আমাদের কারিকুলাম ও সিলেবাসের ব্যাপক সংস্কার সাধন করে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যায় কীনা-সেটা ও ভেবে দেখার সময় এসেছে। বৃত্তিমুলক তথা কারিগরি ও আইসিটি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে , মুল্যায়নের ক্ষেত্রে  ব্যবহারিক পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে, আইসিটি ও হাতে কলমে অর্জিত জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিলে সুফল অবশ্যই পাওয়া যাবে।  
আগামীকাল থেকে সারা দেশে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের আতংকে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় সংশ্লিষ্ট সকলে। এটি আমাদের জাতীয় কলংক। এ কলংক থেকে জাতি পরিত্রাণ পেতে চায়। এ বিষয়ে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অপরিহার্য।  জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে শিক্ষা নিয়ে সব ধরণের বাণিজ্য
রুদ্ধ করতে না পারলে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা কঠিন হবে । 
 
লেখক  :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট । 
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066969394683838