পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : দায়বদ্ধতা থেকেই কালিমা ঘোচাতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় : দায়বদ্ধতা থেকেই কালিমা ঘোচাতে হবে

ড. এম এ মাননান |

সময় কত দ্রুত চলে যায়। এই তো সে দিন, হাতে একটি ছোট ব্যাগ আর কয়েক মাস আগে দেহান্তরিত শিক্ষক বাবার স্মৃতি ও মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে কুমিল্লার একটি ক্ষুদ্র ছায়াঘেরা সবুজ-শ্যামল গ্রাম থেকে মেঠোপথে হেঁটে প্রায় আট কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিয়ে পঞ্চাশ বছর আগে ভীরু পদে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের করিডরে প্রথম পা রাখলাম। বিকম অনার্সে ভর্তি হলাম। প্রথম দিনেই সাবসিডিয়ারি ইকোনমিক্সের ক্লাস। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ১০টায় ক্লাসে এস ঢুকলেন সৌম্য-শান্ত চেহারার একজন শিক্ষক। ড. রেহমান সোবহান, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। প্রথাগতভাবেই তিনি শুরু করলেন ইংরেজিতে লেকচার দেয়া। বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যমূলক অর্থনীতির বিশ্লেষণ। তার প্রাণবন্ত আলোচনা আমাদের সবাইকে এত বেশি মুগ্ধ করে রেখেছিল যে, কখন ক্লাস শেষ হল তা টেরই পাইনি। এমন প্রভাষণ শুনেছি অনার্সের সব ক’টি ক্লাসের শিক্ষকদের কাছ থেকেই- ড. এমএন হুদা, ড. আবদুল্লাহ ফারুক, ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, ড. মো. হবিবুল্লাহ প্রমুখ। এই যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসে থাকা, তা কি এখন এই ২০১৭ সালে আছে? একেবারেই যে নেই, তা অবশ্য বলব না। কিন্তু অতি সামান্য। কারণ কী? আমাদের শিক্ষার্থীরাই অভিযোগের সুরে বলে : বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার গুণে-মানে ধস নেমেছে। কেন এমনটা হচ্ছে? বিষয়টি সিরিয়াসলি পর্যালোচনা করা জরুরি। নতুবা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত এ বিদ্যায়তনটির সুনাম বিলুপ্ত হয়ে যাবে ইতিহাসের অতলে। ১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় চল্লিশ বছর শিক্ষকতা করেছি আমার আলমা-মাতের এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি অবসর নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতি রয়েছে অসীম আবেগ-অনুরাগ। সে কারণেই লেখাটি।

কয়েকদিন ধরে পত্রিকার পাতায় আর ইলেকট্রুনিক মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি, কড়া সমালোচনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি ঘটনার। ঘটনাটি দলীয় সভায় শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষকের হাতাহাতি। কেউ বলছেন, স্তম্ভিত হওয়ার মতো ঘটনা; কেউ বলছেন ন্যক্কারজনক, কলঙ্কিত, অরুচিকর, লজ্জাজনক ও ’নোংরামির চূড়ান্ত রূপ’; আবার কেউ বলছেন, নোংরা দলাদলি ও রেষারেষি। ঘটনাটি হাতাহাতি আর মৃদু মারামারির। সারা দেশে এত হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এটিকে নিয়ে এত শোরগোল কেন? কারণ আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সাধারণ মানুষের হাতাহাতি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতাহাতি একেবারেই ভিন্ন বিষয়। ছাত্রজীবন আর কর্মজীবন মিলেয়ে ৪৬ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি কখনও দেখিনি, শুনিওনি। তবে প্রায় অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল ১৯৮৯ সালের এক বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায়। একটি বিষয়ের ওপর আলোচনা পর্বে পাশাপাশি বসা দু’জন সিনিয়র শিক্ষকের একজন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে অন্যজনের নাকের ডগার কাছে মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে ‘দিব কিন্তু একটা’ এমনটি বলে চিৎকার করে হুঙ্কার দিচ্ছিলেন।

আমি কাছাকাছি একটি চেয়ারে তখন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সভা পরিচালনা করছিলাম। অবস্থা দেখে ত্বরিত উঠে এসে উত্তেজিত হাতটি ভদ্রভাবে ধরে বসিয়ে দিয়েছিলাম। অনেক সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেননি। ব্যাপারটা আলোচনা করে আমরা সেখানেই মিটমাট করে দিয়েছিলাম। তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে কিংবা এরপর আর কখনও এমন ঘটনা ঘটতে দেখিনি। উল্লিখিত দু’জন শিক্ষকই পরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। ছোটখাটো মনোমালিন্য হতেই পারে। একে বড় রূপ দেয়ার চেষ্টার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। আরও একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। এক সময় গোলাপি দল স্বেচ্ছায় ‘নীল দল’-এর সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। গোলাপি দলের কয়েকজন এতে দ্বিমত পোষণ করে সাদা দলে যোগ দেন। অধিকাংশই নীল দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। আর কয়েকজন গোলাপি দল নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদের দলে নেয়া না নেয়া নিয়ে এবং আরও কিছু বিষয়ে মতদ্বৈধতার কারণে এক সময় নীল দলের মধ্যে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দেয়। ‘সবুজ দল’ নামে একটি নতুন দল প্রায় হয়েই যাচ্ছিল; কিন্তু সিনিয়র শিক্ষক নেতাদের যথাযথ ও সময়োপযোগী হস্তক্ষেপের কারণে দল ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়। একটুও হাতাহাতির সম্ভাবনা দেখা দেয়নি। অথচ এখন কেন এত অধৈর্য, অসহিষ্ণুতা? এ ব্যাপারে সিনিয়র শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে একটি দৈনিক পত্রিকার মন্তব্য এরূপ : ‘প্রধানত ছয়টি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই অধিকাংশ শিক্ষক রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। এগুলো হচ্ছে- প্রবেশপদে নিয়োগ, পদোন্নতি, বাসা বরাদ্দ, নিজের অথবা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেয়া’ (যুগান্তর, ৫.১১.২০১৭)। এ মন্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া কঠিন, আবার দ্বিমত পোষণ করাও কঠিন।

রাজনীতিকে এখানে দোষারোপ করা হচ্ছে। শিক্ষকদের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা দোষের কেন? শিক্ষকরা রাজনীতিমনস্ক ছিলেন বলেই বাংলাদেশের ইতিহাস বদলেছে; বিশ্ব এটলাসে নতুন মানচিত্র যুক্ত হয়েছে; বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে; অনাচার-অত্যাচারের হাত থেকে দেশবাসী বাঁচার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। রাজনীতি এখানে সমস্যা সৃষ্টি করছে না। সমস্যার মূলে রয়েছে ব্যক্তিবিশেষের অযোগ্যতা ঢাকার লক্ষ্যে অপরাজনীতির আশ্রয় নিয়ে স্বার্থসিদ্ধ করার প্রবণতা। যারা ক্যাম্পাসে অপরাজনীতি করে বেড়ায় তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে দেখলে দেখা যাবে, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে, আলোকিত জায়গায় তারা বড় হয়নি, অতি বিদ্যা তাদের হৃদয়ের ময়লা ঘোচাতে পারেনি, মুখস্থ বিদ্যা তাদের রেজাল্ট ভালো করতে সাহায্য করেছে কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষাজীবনে অনিয়ম করে তথাকথিত ভালো সনদ অর্জন করেছে। সর্বোপরি, তারা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেয়নি। ভালো, নির্ঝঞ্জাট চাকরি হল শিক্ষকতা, তাই রেজাল্টের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েছে। খুঁটে খুঁটে দেখলে আরও দেখা যাবে, তারা হয়তো কেউ কেউ ‘প্রফেসর’ হয়ে গিয়েছেন; কিন্তু নিজে এককভাবে একটি প্রবন্ধও লিখে প্রকাশ করতে পারেননি। গবেষণা পুস্তক প্রকাশ করা তো বহু দূরের কথা। অনেকে কোনো গবেষণা না করেই আপগ্রেডেশনের বদৌলতে উচ্চতর পদে নিয়োগপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করেছেন। নামকাওয়াস্তে কিছু প্রবন্ধে অন্যদের নামের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করে দিয়েছেন। এমন প্রবন্ধও আছে যা লিখতে একজনই যথেষ্ট, সেখানে রয়েছে চার-পাঁচজনের নাম রচয়িতা হিসেবে। কোয়ালিটির কথা বাদই দিলাম। কোয়ালিটির বিষয়টি দেখার কোনো সিস্টেমিক পন্থা তো নেই-ই; এমনকি এ ব্যাপারে কারও কোনো গরজও নেই।

প্রশাসনের যাদের দেখার কথা, তারা থাকেন নন-একাডেমিক কাজে বেশি ব্যস্ত। চিন্তা-ভাবনার সময় কোথায়? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত ভিজিটর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তিনি কখন একাডেমিক উন্নয়নের চিন্তা করবেন? দিনের বেলায় যদি তিনি বিভিন্ন বিভাগের/ইন্সটিটিউটের হরেক রকমের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে কেবল মাল্যবরণ করতে থাকেন কিংবা বাইরের জগতে অপ্রয়োজনীয় সভা-সেমিনার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির কথা ভাববেন? যদি তিনি প্রত্যেক দিন না হলেও অন্তত সপ্তাহে দুই-তিন দিন ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে না দেখেন, যাকে ব্যবস্থাপনার ভাষায় বলা হয় ‘ম্যানেজমেন্ট বাই ওয়াকিং এরাউন্ড’, তাহলে তিনি কীভাবে বুঝবেন কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কী প্রয়োজন, ক্যাম্পাসের কোথায় অবৈধ কাজকর্ম হচ্ছে, কোথায় গাঁজার আসর বসছে, কোথায় মাদকের ব্যবসা চলছে, কোথায় আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে, ক্যাম্পাসের কোথায় সৌন্দর্যবর্ধন প্রয়োজন, কোন্ বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সময়মতো অফিসে আসছেন না অথবা এসেও অন্যত্র সময় দিচ্ছেন কিংবা কারা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লাউঞ্জে বসে আডডা মারছেন। সময় কোথায় তার শিক্ষার্থীদের মনের কথা শোনার? তারা কী চায়, কী তাদের সমস্যা, সামাজিক চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে কোথায়, কীভাবে এসবের সমাধান করা যায়, আরও কত কী! প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি হবেন একজন সত্যিকারের মাঠকর্মী।

তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসবেন, তাতে সমস্যা নেই। ফাইল ওয়ার্ক তো করবেনই; কিন্তু তার কর্মজগৎ এর বাইরেও বিশালাকারে বিস্তৃত। সেই বিশালতাকে বোঝা খুব জরুরি। কেউ এটিকে আমার নছিয়ত বলে মনে করবেন না, আশা করি। এটিই বাস্তবতা, সমাজেরও প্রত্যাশা। প্রশাসক এবং শিক্ষক সবারই রাজনীতি হবে শিক্ষার্থীর জন্য কল্যাণমুখী। এমনটি হলে কেউ শিক্ষক রাজনীতির দিকে আঙুল তুলে কথা বলবে না। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ১৯৮১-৮৩ পর্যন্ত গবেষক-শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সেখানকার শিক্ষকরা কর্মরত অবস্থাতেই এমপি হতে পারেন, রাজনীতি চর্চা করতে পারেন। আমার একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বন্ধু, লোকসভার সদস্য ছিলেন। শিক্ষক রাজনীতি সেখানেও আছে; কিন্তু তা কলুষিত হয়নি। শিক্ষার্থীরা জানেই না কোন্ শিক্ষক কোন্ দলের। যা হয় নীরবে হয়। দোষ যদি কিছু হয় তা ব্যক্তি বিশেষের জন্য হয়, রাজনীতি সেজন্য দায়ী নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সুস্থ রাজনীতিকে ধারণ করেই কীভাবে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাঙ্গন নিশ্চিত করা যায়, সে সম্পর্কে কিছু করণীয় রয়েছে। আমার ভাবনা এখানে তুলে ধরলাম :

(ক) ঢাকাসহ মোট চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের ‘বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ’ অনুযায়ী চলে আর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে নিজ নিজ আইন অনুযায়ী। সবাই স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। সব আইনেই উপাচার্যদের অপরিমিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইন সংস্কারের মাধ্যমে এ ক্ষমতার রাশ টানা দরকার। আইনে উ-উপাচার্য প্রায় ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমতাই দেয়া হয়নি। উপাচার্য ইচ্ছা করলে কিছু কাজের দায়িত্ব দেন; না দিলে তাদের কিছুই করার থাকে না। এটিও সুপ্ত ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

(খ) সাধারণভাবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা সনাতনী। একমাত্র উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে কি একজন শিক্ষকের যোগ্যতা যাচাই করা সম্ভব? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সার্বিক দায়িত্বের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। একজন আদর্শ শিক্ষকের থাকতে হবে সুন্দর হৃদয়গ্রাহী বাচনভঙ্গি, সাবলীল ভাষার প্রয়োগে বিষয়- বস্তু ব্যাখ্যা করার দক্ষতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ভাব প্রকাশের ক্ষমতা, উভয় ভাষায় শুদ্ধ করে লেখার যোগ্যতা, গবেষণা করার মনমানসিকতা, ক্লাসরুমে সঠিক শিক্ষা-শিখন পদ্ধতি ব্যবহারের ওপর দখল, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করার কৌশল-জ্ঞান এবং সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো বিষয়বস্তুভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা। রেজাল্ট ভালো হলেই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়ে যায় না। তাই সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে হলে লিখিত পরীক্ষা নেয়া এবং ক্লাস ডেমোনস্ট্রেশন জরুরি। এগুলোতে যোগ্য মনে হলে শিক্ষকতার এপ্টিটিউড টেস্ট করাও প্রয়োজন। আর মৌখিক পরীক্ষায় ৫/১০-এর বেশি নম্বর থাকা ঠিক নয়। বেশি নম্বর থাকা মানে অনিয়মের সুযোগ করে দেয়া।

(গ) আশির দশকের প্রথম দিকে আপগ্রেডেশন সিস্টেম খুবই ভালো উদ্দেশ্যে করা হলেও এর অপব্যবহার সর্বজনবিদিত। উল্লিখিত শর্তাবলি ঠিকঠাকভাবে পালন করা হলে সমস্যা কখনও হতো না। শর্ত মানা হয়, তবে এর মধ্যে থাকে অনেক কাহিনী। যেমন- ‘বর্তমান’ পদে কত বছর সক্রিয় কাজের অভিজ্ঞতা দরকার তা নির্ধারিত আছে; কিন্তু বাস্তবে অনেক রকমের ‘রিবেট’ দিয়ে সময়কালের শর্ত পূরণ করে দেয়া হয়। ফলে যথেষ্ট অভিজ্ঞ হওয়ার আগেই একজন শিক্ষক ওপরের পদে চলে যাচ্ছেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে ‘একসেপ্টেন্স লেটার’ জমা দিয়েও প্রকাশনার শর্ত পূরণ করা হয়। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করবে; সিলেকশন বোর্ড সেটি মূল্যায়ন করবে; তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু যে প্রবন্ধ প্রকাশিতই হয়নি, সেটির মূল্যায়ন কীভাবে হবে? সুতরাং জোড়াতালি চলছে, চলবে। আবার কয়েকজনে মিলে রচিত প্রবন্ধে প্রার্থীর ভূমিকা কতটুকু, তা কীভাবে জানা যাবে? আমি যে কয়টা মৌখিক পরীক্ষায় সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেছি সেখানে প্রবন্ধের ওপর প্রশ্ন করার কোনো গরজ কারও মধ্যে দেখিনি। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। নতুবা ‘প্রমোশনে’ পার পাওয়ার জন্য অগ্রহণযোগ্য ’রাজনীতি’ চলতেই থাকবে।

(ঘ) শিক্ষকদের রচিত পাঠ্যপুস্তক ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের মান মূল্যায়নের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করা প্রয়োজন। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে উচ্চতর পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়।

(ঙ) ভিসি নিয়োগে সার্চ কমিটির কথা বহুবার বলা হলেও এ ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সার্চ কমিটি থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। কমিটি শিক্ষাগত নৈপুণ্য ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে ৫/৬ জনের নাম সুপারিশ করবে, তাদের মধ্য থেকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিনেট সদস্যারা নিয়মানুযায়ী তিনজনকে মনোনয়ন দেবেন। এ তালিকা থেকে চ্যান্সেলর একজনকে নিয়োগ দেবেন। এতে অভ্যন্তরীণ টানাটানি অনেকটা কমবে।

(চ) ৭৩-এর আদেশে কিছুটা পরিমার্জন করে নির্বাচনের সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। বিশেষ করে ডিন নির্বাচন বন্ধ করে ফ্যাকাল্টির শিক্ষকদের মধ্য থেকে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে ডিন নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, যা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে হচ্ছে এবং ভালো ফলও পাওয়া যাচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ডিন নির্বাচনের কারণেই মূলত ফ্যাকাল্টির ভেতরকার বিভাগগুলোর শিক্ষকদের মধ্যকার সম্পর্ক বহুলাংশে তিক্ততায় ভরে ওঠে। এমনকি বিভাগের ভেতরেও শিক্ষকরা সম্ভাব্য প্রার্থীকে মাথায় রেখে দলাদলি শুরু করেন। এর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের ওপর। ডিন নির্বাচন শিক্ষকদের আন্তঃসম্পর্কের ভিত একেবারে তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে সবার চোখের সামনে। এ যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। এ ছাড়াও শিক্ষক সমিতির নির্বাচন প্রতি বছরের পরিবর্তে প্রতি দুই বছর পরপর অনুষ্ঠিত হলে বার্ষিক নির্বাচনী ঝাঁঝের হাত থেকে সবাই বাঁচবে। (ছ) আরেকটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ না করেই নতুন বিভাগ/ইন্সটিটিউট খোলা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত বছরগুলোতে নতুন বিভাগ খোলার হিড়িক পড়ে গেছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, শিক্ষক নেই, জনবল নেই; কিন্তু খোলা হয়েছে বিভাগ। প্রস্তাবদাতা বিভাগ থেকে শিক্ষক নিয়ে একজনকে চেয়ারম্যান বানিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম। নতুন বোতলে পুরনো পানীয়। এধারকা মাল ওধারমে ঢাল অবস্থা। দেশের লাভটা কী হচ্ছে? নতুন বিভাগ খোলা নিয়েও প্রায় সময় ভেতরকার রাজনীতি গরম হয়ে ওঠে। সম্ভাব্যতা যাচাই ব্যতীত নতুন বিভাগ খোলার রীতি বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। (জ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। মনোজাগতিক উন্নয়নে নিজকে নিয়োজিত করার সুযোগ পেলে বেহুদা কাজের প্রতি স্বাভাবিক কারণেই আগ্রহ কমে যাবে। (ঝ) শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। নতুন জ্ঞানের তথ্য বিস্তরণ ছাড়াও নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের ‘সফ্ট স্কিল’ উন্নয়ন ও আচরণগত পরিবর্তন সাধনসহ তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইনোভেটিভ হওয়ার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা যায়। এজন্য আলাদা বিশেষায়িত ট্রেনিং একাডেমি স্থাপন করা জরুরি। (ঞ) শিক্ষকদের আরও বেশি করে প্রফেশনাল কাজে ‘এনগেজ’ কারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এটি সহজে করা সম্ভব।

সর্বশেষে শুধু এটুকু বলতে চাই, আজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতাহাতি হয়েছে, কাল হবে ঠ্যাঙ্গাঠ্যাঙ্গি। তারপর? তারপর সর্বনাশ ছাড়া আর তেমন কিছু থাকবে না। কামনা করি, হোক আমাদের বিবেকের জাগরণ; বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক মুক্তবুদ্ধি আর জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

ড. এমএ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! - dainik shiksha শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ - dainik shiksha ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044651031494141