বার্লিন দেয়াল পতনের পেছনে গুন্টার শাবোস্কির হঠাৎ ঘোষণা দায়ী নাকি তিনি পরিকল্পনামাফিকই কাজটা করেছেন, তা আজও রহস্য। তবে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভেদের দেয়াল যে সেদিন ধসে পড়েছিল, সেটা অনিবার্য সত্য। আর সেই অনিবার্যতা যে শুধু জার্মানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, তা নয় বরং তা গোটা বিশ্বকেই যেন নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া সমর্থিত পূর্ব জার্মানি এবং আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স সমর্থিত পশ্চিম জার্মানির মাঝখানে বার্লিন দেয়ালখ্যাত সেই বিভেদ টেনে দেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালে। ওই দেয়ালে চূড়ান্তভাবে চিড় ধরতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন দশক। ইউরোপজুড়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা জার্মান ভূখণ্ডকেও ছাড় দেয়নি, যার জেরে শেষ পর্যন্ত ধসে পড়ে বার্লিন দেয়াল।
আশির দশকেই দেখা দিয়েছিল অস্থিতিশীলতা। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন চরম অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, দেখা দিয়েছিল খাদ্যাভাবও। রাজনৈতিক সংস্কারের জিকির ওঠে তখন থেকেই। সংস্কার আন্দোলনের সেই জোয়ার পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। সে সময় বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলোয় ৩৭০ মাইল দীর্ঘ মানববন্ধন তৈরি করে ইতিহাস গড়েছিল স্বাধীনতাকামীরা। এসব ধারাবাহিকতার অনিবার্য পরিণতি থেকে বাদ পড়েনি জার্মান ভূখণ্ডও।
১৯৮৯ সালে ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানিতে তখন সন্ধ্যা ৭টা। নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য এবং দলের মুখপাত্র শাবোস্কি। সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে শেষ মুহূর্তে তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় হাতে লেখা একটি কাগজ। দলের ছোট কমিটির এক নতুন সিদ্ধান্ত লেখা ছিল তাতে। আসলে কাগজে কী লেখা ছিল, সেটা পড়ার ফুরসত তখন তাঁর হয়নি। ফলে সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে লেখাটা পড়তে গিয়ে নিজেই হোঁচট খেয়েছেন শাবোস্কি। খাবি খেতে খেতে তিনি পড়েছেন, ‘এখন থেকে কোনো রকম পূর্ব শর্ত ছাড়াই দেশের বাইরে ব্যক্তিগত ভ্রমণ করা যাবে।’
লিখিত বক্তব্যটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত সাংবাদিকরা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাঁরা জানতে চান, কখন থেকে কার্যকর হচ্ছে এ আদেশ। প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কাগজটি নেড়েচেড়ে দেখে শেষ পর্যন্ত শাবোস্কি বেশ থেমে থেমে বললেন, ‘আমি যতদূর জানি... এখন থেকেই।’ অথচ বাস্তবটা হলো, ঘোষণার পরদিন থেকে ওই আদেশ কার্যকর করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিদেশ ভ্রমণের ভিসা প্রদানের নিয়ম-কানুনও পরদিন বিস্তারিত জানানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শাবোস্কির ঘোষণা যেন পূর্ব জার্মানির বাসিন্দাদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটাল।
ঘোষণাটা যেহেতু টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল, তাই খবর ছড়াতে দেরি হয়নি। ঝাঁক বেঁধে লোকজন সীমান্তের দিকে ছুটতে শুরু করে। সেই লোকজনকে ঠেকানোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ না পেয়ে শেষমেষ সীমান্ত রক্ষীরা নীরব ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ভিড়ের মানুষজন যেভাবে ঠেলাঠেলি করছিল, তাতে ভয় পেয়ে সীমান্ত খুলে দেওয়ার নির্দেশই দিয়েছিলেন সেখানে দায়িত্বরতদের একজন হ্যারাল্ড জ্যাগার। আনন্দের উন্মত্ত লোকজন সেদিন বার্লিন দেয়ালের ওপর উঠে নাচানাচি করছিল। কেউ কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছিল।
দ্বিখণ্ডিত জার্মানিতে রাজত্ব করতে থাকা চার শক্তির কেউ সেদিন ওই বাঁধভাঙা স্রোত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ তো আগে থেকেই ‘সংস্কার আর জবাবদিহি’ নিশ্চিত করার কথা বলে আসছিলেন। ফলে সেদিন যেন বাধাহীনভাবেই দুই জার্মানি এক হয়ে গিয়েছিল। সে ক্ষেত্রে শাবোস্কির ভূমিকা নায়কের নাকি খলনায়কের, তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। তবে সেই ঘটনা যে গোটা বিশ্বকে আগাপাশতলা বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছিল, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
শাবোস্কি নিজেও অবশ্য বার্লিন দেয়াল পতনের সেই বিতর্ক নিরসন করেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ঘোষণায় তত্ক্ষণাৎ যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা কেউ ঠেকাতে পারত না।’ কিন্তু ঘোষণাটা পরিকল্পিত ছিল নাকি আকস্মিক, তা তিনি আমৃত্যু স্পষ্ট করেননি।
বিতর্কিত সেই ঘোষণা প্রদানকারী শাবোস্কিকে সীমান্তে ‘দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ’ শীর্ষক আরেক বিতর্কিত নির্দেশে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৯৭ সালে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০০ সালে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সূত্র : এএফপি, বিবিসি।