পেছাল মুদ্রণ কাজ বাড়ল ব্যয় - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকের পাঠ্যবই নিয়ে দুই সিন্ডিকেটের কারসাজিপেছাল মুদ্রণ কাজ বাড়ল ব্যয়

মুসতাক আহমদ |

সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে তিন মাস পিছিয়ে গেছে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণ কাজ। সেই সঙ্গে বেড়েছে ছাপার ব্যয়। মুদ্রণ দর প্রাক্কলনের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি হাঁকার অজুহাতে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার ডাকে। কিন্তু সেই টেন্ডারেও প্রথমবারের তুলনায় ১১ কোটি টাকা বেশি দরে কাজ দিতে হয়েছে। অথচ বাজারদর যাচাই করে প্রথম টেন্ডার নিষ্পত্তি করা হলে সরকারের এই বাড়তি সময় এবং অর্থ ব্যয় উভয়ই বেঁচে যেত। এমন পরিস্থিতিতে অক্টোবরের মধ্যে মাঠপর্যায়ে বই পৌঁছানো কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। অথচ নির্বাচনী বছর হওয়ায় সরকার এবার অক্টোবরে বই পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৯০ শতাংশ বই পৌঁছে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য প্রথম ডাকা টেন্ডার বহাল রেখে নতুন প্রাক্কলন করে কাজ দেয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু বাকি সদস্যরা রহস্যজনক কারণে একজোট হয়ে পুনঃটেন্ডারের পক্ষে মত দেন। এই দুটির কোনোটিই না রেখে কর্তৃপক্ষ নতুন টেন্ডার আহ্বান করে। মূলত পছন্দের বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে এমনটি করা হয়। কেননা পুনঃটেন্ডার দিলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে না। তাই নতুন টেন্ডারে অভিজ্ঞতা ৩ বছরের স্থলে এক বছরে নামানোসহ আরও কয়েকটি শর্ত শিথিল করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজের পথ সুগম করা হয়। এটা করতে গিয়ে একদিকে প্রায় ৩ মাস সময় লেগেছে। পাশাপাশি ১১ কোটি টাকা ব্যয়ও বেড়েছে। অথচ আগের টেন্ডার রেখে শুধু প্রাক্কলন ঠিক করা হলে সময় ও অর্থ উভয়ই সাশ্রয় করা যেত। এমনকি পুনঃটেন্ডার করা হলেও ২৫ দিন সময় বেঁচে যেত। কেননা পুনঃটেন্ডারে ২১ দিনের সময় দিতে হয় টেন্ডার দাখিলে। আর নতুন টেন্ডারে ৪৫ দিন সময় দিতে হয়েছে। এসব কারসাজির নেপথ্যে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানের ভূমিকা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘টেন্ডার নিয়ে যা করা হয়েছে তা নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার ইচ্ছা বা কারসাজির কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, একক সিদ্ধান্তে নতুন টেন্ডার আহ্বান হয়নি। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি, মন্ত্রণালয়, সরকারি ক্রয় কমিটি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরে কাজ দেয়া হয়েছে। পছন্দের বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ যারা করছেন তারা অসত্য বলছেন।’

দ্বিতীয় দফার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ১৩ আগস্ট দরপ্রাপ্তদের নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) দেয়া হয়। নিয়মানুযায়ী মুদ্রণকারীরা এরপর চুক্তি করতে ২৮ দিন সময় পাবেন। ফলে অনেকেই এনওএ নিয়ে এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করেননি। সে কারণে মুদ্রণ কাজ শুরু হতে আরও দু’সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। আবার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পরও বই সরবরাহের জন্য প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান ৮৪ দিন সময় পাবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে বই দিতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত গড়াবে। এছাড়া জরিমানা দিয়ে বই সরবরাহে অতিরিক্ত ১ মাস পান মুদ্রাকররা। সেই হিসাবে এবারও জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ বই সরবরাহ পৌঁছাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাথমিক স্তরের বই নিয়ে এবার দুটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। এর একটি গড়ে উঠেছে দেশীয় মুদ্রাকরদের সমন্বয়ে। আরেকটির নেপথ্যে আছেন খোদ এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কয়েকটি বিদেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। গত মার্চ মাসে প্রথম ডাকা টেন্ডারে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিতারিত হয়ে যায়। সিন্ডিকেটের কারণে প্রায় ১১ কোটি বইয়ের সব কাজ পেয়ে যায় দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান তখন সিন্ডিকেট করে দর বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রাক্কলনের প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি দর ওঠে। প্রথমে এই টেন্ডারে প্রতি ফর্মা ২ টাকা ২৫ পয়সা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। আর দর পড়েছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯৩ পয়সা। এতে ৯৮ লট বইয়ের গড়ে প্রতি ফর্মার ব্যয় দাঁড়ায় ২ টাকা ৭৩ পয়সা। অর্থাৎ প্রাক্কলনের চেয়ে ব্যয় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি দাঁড়ায়। তখন টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী সময় ও বাস্তবতা বিবেচনা করে টেন্ডার বহাল রেখে পুনরায় বাজার যাচাই করে প্রাক্কলন পুনর্নির্ধারণের পক্ষে মত দেন। সরকারি ক্রয় আইনের (পিপিআর) ৯৮(২৫) ধারায় এমন নির্দেশনা আছে। এটা করা হলে পুনঃটেন্ডার বা নতুন টেন্ডারের সময়ক্ষেপণ বন্ধ হয়। কিন্তু বাকি সদস্যরা রহস্যজনক কারণে পুনঃটেন্ডারের পক্ষে মত দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পুনঃটেন্ডারের সিদ্ধান্ত পাস হয়। এমন পরিস্থিতিতে ড. সিদ্দিকী ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত এনসিটিবি পুনঃটেন্ডারেও না গিয়ে নতুন টেন্ডার করে।

জানতে চাইলে অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, প্রাক্কলনের দর নির্ধারণ করা হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। আর টেন্ডার নিয়ে কাজ করছিলাম এপ্রিলে। ততদিনে বাজারে কাগজ, কালিসহ অন্যান্য মুদ্রণ সামগ্রীর দাম বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাথমিকের বইয়ের কাগজের মূল উপাদান ভার্জিন পাল্পের (অব্যবহৃত মণ্ড) দাম অনেক বেড়েছে। তাই আমি টেন্ডার বহাল রেখে প্রাক্কলন পুনর্নির্ধারণের পক্ষে ছিলাম। আমি মনে করেছি, সরকারের লক্ষ্য ঠিক রাখতে হলে সময়ের দিকে তাকাতে হবে।’

এদিকে নতুন (দ্বিতীয়) টেন্ডারেও লাভের মুখ দেখেনি এনসিটিবি। জানা গেছে, দ্বিতীয় টেন্ডারে এখন প্রতি ফর্মার দর পড়েছে ২ টাকা ৯৩ পয়সা। সেই হিসাবে প্রথম টেন্ডারের চেয়ে ২০ পয়সা করে ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে সার্বিকভাবে প্রথম টেন্ডারের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। অথচ শুধু প্রাক্কলন পুনর্নির্ধারণ করে প্রথম টেন্ডারে কাজ দেয়া হলে এই বাড়তি ব্যয় হতো না।

দেশীয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই এনসিটিবি এমনটা করেছে। এক্ষেত্রে একজন মাত্র ব্যক্তি মূল ভূমিকা রেখেছেন। এর পেছনের রহস্য বের করতে তিনি গোয়েন্দা তদন্ত দাবি করেন।

দেশীয় আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এবার মুদ্রণ কাজের গোড়া থেকেই নানা অপতৎপরতা শুরু হয়। গত বছর পর্যন্ত ব্যয়ের একটি অংশ বিশ্বব্যাংক থেকে নেয়া হতো। বিশ্বব্যাংকের শর্তে ছিল আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কাজ করা। কিন্তু প্রথমবারের মতো এ বছরের বই হচ্ছে সরকারি অর্থায়নে। সে কারণে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের কোনো বাধ্যবাধ্যকতা ছিল না। কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে এনসিটিবির শীর্ষ এক কর্মকর্তা একক সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কৃষ্ণা ও স্বপ্না নামে বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠান ১০টি লটে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি বই ছাপার কাজ পেয়েছে। এর জন্য তারা ৩৩ লাখ ৫২ হাজার ৭১১ দশমিক ৫২ ডলার বিল পাবেন। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা জানান, ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর কাজের বিল পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে ডলারের চাহিদার কারণে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। সেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া কাজের দর দেশীয় মুদ্রায় আরও বেড়ে যাবে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, নতুন টেন্ডার ডাকায় রাষ্ট্রের তিনটি ক্ষতি হয়েছে। একটি হচ্ছে, কাজ বিদেশে চলে যাওয়ায় ডলারও চলে যাবে। অথচ ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর বিল পরিশোধে আমাদের প্রচুর পরিমাণে ডলার দরকার। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শ্রমিক এবং দেশীয় কলকারখানা কাজ পেল। তৃতীয়টি হচ্ছে, সরকার প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হল। তিনি বলেন, যদি নতুন প্রাক্কলনই করা হবে, তাহলে আগের টেন্ডার বহাল রেখে জটিলতা নিরসন করা হল না কেন? এতে একদিকে সময় সাশ্রয় হতো ও অক্টোবরেই বই চলে যেত। অন্যদিকে বাড়তি অর্থ গুনতে হতো না। তিনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট করার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ব্যয় বাড়ল ১১১ কোটি : এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বইয়ের প্রতি ফর্মা এক টাকা ৯৫ পয়সায় ছাপান মুদ্রণকারীরা। এবার সেখানে খরচ পড়ছে ২ টাকা ৯২ পয়সা। গত বছর প্রতি বইয়ে খরচ পড়েছিল গড়ে ২৬ টাকা। এবার পড়ছে ৩৭ টাকা। সেই হিসাবে ১১ কোটি বইয়ে এবার বাড়তি খরচ হচ্ছে ১১১ কোটি টাকা। গত বছর এই স্তরের বই ছাপাতে মোট খরচ হয়েছিল ২৪৯ কোটি টাকা। এবার খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা।

 

 

সৌজন্যে: যুগান্তর

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045890808105469