সদ্য বিদায়ী বছরের শেষদিনে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ডক্টর তুহিন মালিকের কলাম ‘জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে মানুষ’ পড়লাম। আইনবিদ এ ব্যক্তিত্ব তার লেখায় মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। কিভাবে মানুষ নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে দিনে দিনে অমানুষ হয়ে যাচ্ছে- তাই তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
সত্যি তো, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে বটে, কিন্তু মানবিকতা সম্পন্ন মানুষ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধানের এখনই কি উপযুক্ত সময় নয়?
অনুরুপ, আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে সত্যি, কিন্তু শিক্ষার মান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এক সময় গ্রামে গঞ্জে চিঠিপত্র পড়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। কিন্তু এখন গ্রামে চিঠিপত্র পড়ার লোকের অভাব তো নেই-ই, বরং প্রতি গ্রামে দশ-পাঁচ জন বি.এ-এম.এ পাশ লোকও খুঁজলে পাওয়া যায়।
শিক্ষিত মানুষে দেশ ভরে যাচ্ছে, কিন্তু বিবেকবান ও নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময় বি.এ পাস করে কেউ কেউ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন, কিন্তু আজকাল এম.এ পাস করে ও অনেকে কেরাণীর চাকরি পর্যন্ত জুটাতে পারে না। বিষয়টা কী?
আমাদের দেশ অনেক এগিয়েছে। স্বাধীনতার পরেও অনেক গ্রামে প্রাইমারি স্কুল ছিল না। যা বা দু’এক গ্রামে ছিল, সেগুলোতে ছন বা খড়ের ছাউনি ছিল। আজকাল অনেক পাকা পাকা দালান হয়েছে। আশির দশকেও যেখানে অনেক প্রাইমারি স্কুলে মাত্র একজন বা দু’জন শিক্ষক ছিলেন, আজ সেখানে প্রায় সকল স্কুলে সাত-আট জন এমন কি দশ জন পর্যন্ত শিক্ষক। ছাত্র সংখ্যাও বহুগুণে বেড়েছে, এ কথা সঠিক বটে। কিন্তু আমাদের লেখাপড়ার মানের এতো ক্রমাবনতি কেন?
এমনও তো দিন গেছে, যখন সারা থানা (উপজেলা)’র মধ্যে মাত্র একটি বা দু’টি হাই স্কুল ছিল। সারা উপজেলার মধ্যে কোন কলেজ ছিল না। সারা দেশে মাত্র পাঁচ ছ’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আর এখন? প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে হাই স্কুল হয়েছ, একেকটা উপজেলায় চার-পাঁচটা কলেজ হয়েছে, শহরের অলিতে-গলিতে, বিপণি-বিতানে ভার্সিটি হয়েছে। কিন্তু লাভ কী হচ্ছে?
আজকাল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় কেনো যেন মন বসে না। পড়াশুনা এখন জ্ঞান ভিত্তিক না হয়ে পরীক্ষা ভিত্তিক হয়ে গেছে। সন্তান লেখাপড়া করুক আর নাই করুক জিপিএ-৫ পেলেই হলো। পরীক্ষা পাসের জন্য সকলেরই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। সন্তান পরীক্ষায় ভালো করুক, সে আমরা সকলেই চাই। লেখা পড়া করে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ হউক- সে আমরা ক’জনে চাই?
আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারে কতো কিছুই না করা হলো? প্রচলিত ধারা পরিবর্তন করে রচনামূলক ও নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন চালু করা হলো। এর পর থেকেই আমাদের শিক্ষায় ধ্বংস নামতে শুরু করলো। এখন সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনীর নামে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর আরো আগে ‘নকল’ নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমাদের জাতিটা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এখন সে মহামারিটা অবশ্য নেই। তবে ইদানিং বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি আমাদের জাতীয় কলঙ্কে পরিণত হয়েছে। অবশ্য, গত পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা না ঘটলে ও মেডিকেলে ভর্তিসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। জাতি যেন কোন ভাবে এ শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছে না।
এ ক’বছরে পরীক্ষায় পাসের হার যেন জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। পাসের হার বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, এক সময় হয়ত আমরা ‘ফেল’ নামটাই ভুলে যাব। পাসের হার বৃদ্ধি ও জিপিএ-৫ অর্জনের এক অশুভ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছি আমরা। এতো পাস আর এতো জিপিএ-৫ দিয়ে কী হবে?
সারাটা দেশ জিপিএ-৫ এ ভরে যাচ্ছে। সকলেই পাসের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। গতকাল বছরের শেষদিনে পিএসসি-সমমান এবং জেএসসি-সমমান পরীক্ষাগুলোর ফলাফল কী আমাদের এমন শঙ্কার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে না? নববর্ষের এ শুভদিনে আজ ১ জানুয়ারি ‘প্রশ্ন ফাঁস’ ও ‘গণ পাস’ থেকে জাতির মুক্তি কামনা করছি।
লেখক : মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।