দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির দাবি দীর্ঘদিনের। এতে একদিকে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চরম দুর্ভোগ ও হয়রানির অবসান ঘটবে, অন্যদিকে অভিভাবকদের গুচ্ছের খরচসহ অবসান ঘটবে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার। এ নিয়ে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার। এতে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে ইউজিসি। তবে ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
আরও যা আশ্চর্যের তা হলো, তথাকথিত ‘স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা’ বজায় রাখার স্বার্থে ঢাবিকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বাইরে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ডাকসু। বুয়েট ও ঢাবি কর্তৃপক্ষেরও এর সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, যা বিবেচনার দাবি রাখে। এই প্রেক্ষাপটে ইউজিসি চেয়ারম্যানের মন্তব্যটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বুয়েট ও ঢাবির সিদ্ধান্তহীনতার জন্য সমগ্র জাতির আকাক্সক্ষা অপূর্ণ থাকতে পারে না। কারও ‘ইগো’ যেন প্রভাবিত না করে অন্যদের সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। বুয়েট ও ঢাবি কর্তৃপক্ষকেও এক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এখন সময়ের দাবি, যা অনুষ্ঠিত হতে পারে কেন্দ্রীয়ভাবে ইউজিসির তত্ত্বাবধানে।
আত্মপক্ষ সমর্থনে উপাচার্যরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। সেগুলোকে সমন্বয় করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জটিলতা ও গোপনীয়তা রক্ষা, মাইগ্রেশন পদ্ধতি কিভাবে থাকবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়ার জন্য প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ ভর্তি নীতিমালা। সেটি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বিধায় ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই উদ্যোগ চলছে ২০০৮ সাল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা তথা সংস্কার করতে গিয়ে তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সে সময় অধিকাংশ ভিসি একমত পোষণ করলেও বেশ কয়েকজন স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় এর বিরোধিতা করেন।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতার আসার পর আবারও এ নিয়ে বৈঠক করে। সেখানে ঢাবি, বুয়েটসহ কয়েকটি নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা এর বিরোধিতা করেন একই অজুহাতে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত উপাচার্যদের সভায় অধিকাংশ সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হলেও সংশ্লিষ্ট একটি মহলের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উল্লেখ্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় অভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিলেও স্বার্থান্বেষীদের আন্দোলনের কারণে তা ভ-ুল হয়ে যায়। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কতিপয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক লেখালেখি করলেও অজ্ঞাত কারণে তা ঝুলে আছে।
আরও পড়ুন :
যে কারণে ডাকসু ও ঢাবি প্রশাসন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে
শিক্ষার্থীবান্ধব সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা, তবে...
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে ঢাবির মিশ্র প্রতিক্রিয়া
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে দুই দিন, আবেদন ১০টিতে
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে ঢাবি শিক্ষকের যত যুক্তি
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় প্রাপ্তিতে মেধাই ভিত্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি: সমন্বিত পরীক্ষার বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষক
বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আগামী বছর থেকে
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে চার বিশ্ববিদ্যালয়কে পরামর্শ দিল ইউজিসি
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নতি স্বীকার নয়
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ভোগান্তি কমবে : শিক্ষামন্ত্রী
সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলো একই পদ্ধতির পরীক্ষায় মূলত একই প্রশ্নপত্রে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ। এতে স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও খরচ অনেক কম হয় তুলনামূলকভাবে। ভর্তির চাপ ও বিড়ম্বনাও কমবে অনেকাংশে। তদুপরি অনিয়ম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদির আশঙ্কা থাকবে কম। বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং বুয়েট, চুয়েট, বাকৃবিসহ বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের সারাদেশে ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চরম দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার পাশাপাশি সম্মুখীন হতে হয় গুচ্ছের খরচের। এ বিষয়ে আর্থিক লেনদেনসহ স্বজনপ্রীতি, প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। একাধিক ভুয়া ভর্তিসহ এমনকি পরীক্ষায় আদৌ অংশ না নিয়েও ভর্তির অভিযোগ পর্যন্ত আছে। প্রতিবছর উত্থাপিত এতসব অনিয়ম-অব্যবস্থা-অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমন্বিত, গুচ্ছ পদ্ধতি বা কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা গ্রহণের বিকল্প নেই। ইউজিসি যত তাড়াতাড়ি এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে ততই মঙ্গল। তাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানি এবং দুর্ভোগ কমে আসবে নিঃসন্দেহে।