আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের অপরিহার্যতা সবাই স্বীকার করলেও অতীতে এর জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকার তা নিয়েছে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনুকূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। এই যে সারা দেশে অনলাইনে সব ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, একই দিনে বই বিতরণ, একই দিনে ক্লাস শুরু, একই রুটিনে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণ, অতি স্বল্পতম সময়ে কাগজবিহীন ফলাফল প্রকাশ, এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল জানা ও উত্তরপত্র পুনঃমূল্যায়ন, মোটের ওপর একটা উদ্যম-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে- এ সবকিছুই বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছেন শিক্ষক সমাজ।
শিক্ষকরা তাদের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে কাজ করেছেন ও করছেন সরকারের গৃহীত অনুকূল পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। অন্যথায় এই সফলতাটুকু অর্জন সম্ভব ছিল না মোটেও। আর এই শিক্ষকদের ৯৭ ভাগ হচ্ছেন বেসরকারি। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতায় সংসার চলে না- এটি এখন সবাই জানেন ও বোঝেন। শিক্ষকদের বাধ্য হয়েই বিকল্প উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে সংসারের ন্যূনতম ব্যয় মেটানোর জন্য।
তাই তাদের যোগ্যতানুসারে বেছে নিয়েছেন ওভারটাইম আয়ের রাস্তা। কেউ প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, কেউ নোট-গাইড লিখছেন, কেউ ঠিকাদারি, কেউ জমির ব্যবসা, কেউ রাজনীতি ব্যবসা, কেউ আবার দোকানদারি করছেন, কেউ বাবার/স্বামীর ধন খাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব খাতের আয়ের ওপর যেহেতু তাদের জীবনধারণ করতে হচ্ছে সেহেতু তারা এডিশনাল কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সে কাজেই বেশি সময়, শ্রম ও মেধা খাটাচ্ছেন। ফলে শিক্ষকতায় তাদের মনোযোগ না থাকা বা কম থাকাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়াই বাস্তব। এই বাস্তবতায় প্রাইভেট বা কোচিং না করে শিক্ষার্থীরা পারবে কীভাবে? তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন; তাদের চেয়ে যারা প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন তারা তো ব্যক্তিগতভাবে হলেও শিক্ষকতাই করছেন। নিজের পাঠদানের বিষয়টি নিয়মিত চর্চা করছেন কমবেশি। অন্যরা তো তা-ও করছেন না।
এই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি বলেই হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত নমনীয় নীতি নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের কথা বলে বলে শেষমেশ যে নীতিমালা জারি করেছেন তাকে পরোক্ষ অনুমোদনই বলছেন কেউ কেউ। [যেমন : শিক্ষকরা নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। অন্য প্রতিষ্ঠানের ১০ জনের বেশি পড়াতে পারবেন না। নিজের শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় প্রতি বিষয় শহরে ৩০০, উপশহরে ২০০, গ্রামে ১৫০ টাকা হারে; তবে সর্বমোট অনধিক ১২০০ টাকায় সব বিষয় পড়াতে পারবেন অভিভাবকদের সম্মতিসাপেক্ষে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শাস্তি পাবেন। একটি বিশেষ কমিটি তা মনিটরিং করবে।
এসব পদক্ষেপের ফলে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে, আগে তো কেবল কঠিন বিষয়ে কোচিং হতো এখন হবে সব বিষয়ে। কারণ দুয়েক জন শিক্ষক কোচিং ফি পাবেন আর অন্যরা পাবেন না তা তো হবে না। তাই পরীক্ষায় ফেল করিয়ে কোচিংয়ে বাধ্য করাতে পারেন অতি সহজ বিষয়ের জটিল স্যাররাও।
অপরদিকে নিজের বাসায় বসে বা শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে কোন শিক্ষক কখন কতজন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন তা মনিটর করা আমাদের জন্য দুরূহ কাজ। আমরা তো এখনও আমাদের নিত্যদিনের ওপেন ও প্যাকেট খাবারগুলোই ভেজাল এবং ফরমালিনমুক্ত করতে পারছি না। প্রকাশ্যে সদর রাস্তায় চলা মিটারবিহীন অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব বন্ধ করতে পারছি না। সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে চেষ্টাও করছি না।
অথচ কোথায় কোন গ্রামেগঞ্জে, শহরে কোন ঘরে বসে বা অন্যের ঘরে গিয়ে কবে কখন সকাল-বিকেল রাতে কোন প্রতিষ্ঠানের কতজন শিক্ষার্থীকে কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন তা খুঁজে বের করে শাস্তি দেবেন আর প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ হবে এমনটি অবাস্তব নয় কী? আসলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কি না, তদারকি করা প্রয়োজন সেটি। তা না করে কমিটি বাসাবাড়িতে যেয়ে তদারক করবে শিক্ষকরা সরকারি নিয়ম মেনে প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন কি না। এ যেন ‘চোখের অপারেশন পায়ে’।
একটু গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে অনেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য হয়তো বাসায়ই নিয়োগ দেওয়া আছে একাধিক টিচার। বিশেষ করে নামকরা টিচার ও কোচিং-সেন্টারের আশেপাশের রাস্তায় যেসব দামি দামি গাড়ির ভিড় লেগে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যক্তিদের ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাদের দিয়ে এই প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য বন্ধের তদারকি করানো হবে তাদের কারও সন্তানও যে প্রাইভেট পড়েনি, পড়ছে না এবং পড়বে না, তা নিশ্চিত করবে কে? বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা প্রাইভেট-কোচিং করানো বন্ধ করতে বাধ্য হলেও শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট-কোচিং না করে পারবে না। কারণ শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত। ফলে অশিক্ষকের কাছ থেকে প্রাইভেট-কোচিং নিতে বাধ্য হবে শিক্ষার্থীরা। অশিক্ষকদের তো আর শাস্তি নেই। সে হবে আরও বেশি ক্ষতির কারণ।
আবারও বলছি, দীর্ঘ অতীত ও বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের প্রয়োজনেই চলছে এই প্রাইভেট-কোচিং। কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না। শিক্ষার্থীরা নিজের প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকায় ভর্তি হবে, বেতন-ফি পরিশোধ করবে, আবার নিজের প্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কোচিং ক্লাস করে রিকভার করতে বাধ্য হবে নির্ধারিত ক্লাসের ঘাটতি পড়া! সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে পরিপূর্ণ পাঠদান করাই তো শিক্ষকদের চাকরি। কিন্তু শিক্ষকরা এ কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করছেন কি না তা তদারক করার জন্য কমিটি না করে, করা হল প্রাইভেট-কোচিং তদারকি কমিটি।
একজন শিক্ষক দৈনিক কত ঘণ্টা প্রতিষ্ঠানে থাকবেন, কত ঘণ্টা থাকছেন তার কি কোনো হিসাব নেওয়া হয়? আমার জানা মতে, এমনও শিক্ষক আছেন যারা ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে থেকে চাকরি করছেন অন্য জেলার সরকারি-বেসরকারি কলেজে। সপ্তাহে যাচ্ছেন ৩-৪ দিন। চল্লিশ মিনিটের ক্লাস নিচ্ছেন দিনে দুয়েকটি মাত্র। তাদের মাসিক কর্মঘণ্টা ৮/১০/১৬/২০ ঘণ্টার। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি আছে এমন কলেজের একজন শিক্ষক যদি প্রতিদিন চল্লিশ মিনিটের দুটি করে ক্লাস সপ্তাহে ছয় দিনই নেন তবুও তার মাসিক কর্মঘণ্টা হবে সর্বোচ্চ ৩২ ঘণ্টা। এর বাইরে হয়তো কিছু পরীক্ষা নেওয়া আর খাতা দেখা। দৌড়ে এসে ক্লাস আবার ক্লাস শেষ হলেই দৌড়। এক কাজ থেকে এসে আবার ছুটছেন অন্য কাজে। পত্রপত্রিকা পড়ার সময় এবং ধৈর্য্যও নেই অনেকেরই। গবেষণা তো দূরের কথা। শিক্ষকরা এমন হলে শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? কমবেশি একাদশ শ্রেণির ১২০ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ১২০ জনসহ মোট ২৪০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন করে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষক যথেষ্ট কি না তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে বের হতে হলে অবশ্যই বাড়াতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে কর্মঘণ্টা। শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে অবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন আর না থাকে ক্লাসের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা। তা না হলে বন্ধ করা সম্ভব হবে না এই প্রাইভেট-কোচিং।
লেখক : শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।