আগামী প্রজন্মের শিশুরা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে এ প্রত্যাশা সকলের। ঠুনকো অহমিকা ও নৈতিক অবক্ষয়ের মাঝে নিজের অবস্থান রেখে শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। বড় বড় পাসের জন্য শিক্ষকদের পরীক্ষার হলে বলে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এ যে অনৈতিক কাজ তা শিক্ষক-অভিভাবক বেমালুম ভুলেই বসছে।
পরীক্ষার্থীদের মনে ভাবনা জন্মাচ্ছে, এ কি শিক্ষক! না নকল যোগানদাতা? শিক্ষক, অভিভাবক হারাচ্ছে তাদের প্রাপ্য সম্মান। এতে শিশু মনে জন্ম নেয় ঘৃণা। একটু বড় হলে তাদের দ্বারা সংঘঠিত হয় নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড। তখন আমরা একযোগে এসব অপকর্মের নিন্দা করে থাকি। কতিপয় শিক্ষক নৈতিক ও অনৈতিক কাজ গুলিয়ে ফেলেছে। তারা শিশুদের জ্ঞানার্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় পরীক্ষায় নানা উপায়ে বড় বড় পাস নেয়া। দুর্বল চিত্তে বুক টান করে জিপিএ ফাইভের জন্য বাহবা নেয়। এ নিছক অহংকার। অনেকটা ‘উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’ প্রবাদের মত।
গত ৮ নভেম্বর ঢাকা শহরের মিরপুর থানা শিক্ষা অফিসার সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ৭টি স্কুলে ফল নয় ছয় করে মেধাবৃত্তি প্রদানের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়। উক্ত কর্মকর্তা ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মতিঝিল থানার প্রধান পরীক্ষকদের কাছে একাধিক বার ধর্না দেন। নম্বর ফর্দ ও খাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আরেকটি ঘটনা কুমিল্লার তিতাস ও বুড়িচং উপজেলায় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ‘উত্তরপত্র জালিয়াতি করেও পুরস্কৃত শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্রে টেম্পারিং করে নম্বর বৃদ্ধির অভিযোগ প্রমানিত হলেও শাস্তির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও স্কুলকে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জানা যায় ওই ঘটনার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট একটি স্কুল এবং এক পরীক্ষককে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০১৭ এ শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে।
কুমিল্লার তিতাস ও বুড়িচং উপজেলার সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও স্কুলের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবী জানিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রদান করা এক অভিযোগের মাধ্যমে।
অভিযোগে বলা হয়, গত প্রাথমিক সমাপনী ২০১৬ পরীক্ষায় কুমিল্লার তিতাস উপজেলার উত্তরপত্র নিরীক্ষার দায়িত্ব পান বুড়িচং উপজেলার বিভিন্ন পরীক্ষকবৃন্দ।
জানা যায়, তিতাস উপজেলার গাজীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাবুবুল হক সরকার ও বাতাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: আক্তার হোসেন মিলে যোগসাজশ করেন। তারা বুড়িচং উপজেলার গণিত বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক মো: কামরুল হাসান এবং বিজ্ঞান বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক ফরিদা বেগমের সাথে যোগসাজশ করে অর্থের বিনিময়ে তিতাস উপজেলার ওই দুই স্কুলের ৩২ পরীক্ষার্থীর ৬ বিষয়ের উত্তরপত্রের ভেতরে, কভার পেইজে এবং মার্কসীটে টেম্পারিং এর মাধ্যমে নম্বর পরিবর্তন করেছে।
অভিযোগে দাবী করা হয় ফল পরিবর্তনের এ ঘটনায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে প্রমাণিত হয়। ফলে সংশিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে মামলা এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ওই ৩২ পরীক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো দীর্ঘ ১০ মাস পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ব্যবস্থা তো নেয়া হয়নি বরং ওই ৩২ পরীক্ষার্থীর ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশ করা হয়। আরও দু:খের বিষয় হল জালিয়াতির সাথে জড়িত সংশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের মধ্যে থেকে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০১৭ এ তিতাস উপজেলার গাজীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এবং বুড়িচং উপজেলার গণিত বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক মো: কামরুল হাসানকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। নভেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে অভিযু্ক্ত শিক্ষকদের কেবলমাত্র পরীক্ষার সব ধরণের কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।
এঘটনায় তিতাস ও বুড়িচং উপজেলার সচেতন শিক্ষক অভিভাবক ও সুশীল সমাজ তীব্র ক্ষোভ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা মনে করে এভাবে চলতে থাকলে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের পরিবর্তে অবনতি হবে। এর ফলে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। তাই এই জালিয়াতিমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যেহেতু অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেহেতু ও যারা দোষীদের প্রশয় দিচ্ছে তাদেরও দ্রুত শাস্তি আজকের প্রত্যাশা।
কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বোধ শক্তি লোপ পেয়ে নৈতিক অবক্ষয় আজ চরমে পৌছেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে প্রজন্ম রসাতলে যাবে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিকশিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।