প্রাথমিকে ছুটি নিয়ে যন্ত্রণা কেন বার বার - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে ছুটি নিয়ে যন্ত্রণা কেন বার বার

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

বিগত বছরগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্টরাসহ খোদ মন্ত্রণালয়ের মূখ্য কাজ যেন, শিক্ষকদের সমস্যা জিইয়ে রাখা। সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হয়ে তারা এতে গিট্টু লাগিয়ে দেয়ার কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের শিক্ষায় অসংখ্য অর্জন। অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় ব্যক্তিবর্গ। পাকিস্তান আমল থেকে হয়ে আসছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ছুটি ৭৫ দিন। এ ছুটি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ৮৫-৯০ দিন। আজও ৭৫ দিন ছুটির তালিকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে আসছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটির পরিমাণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সমপরিমাণ থাকা প্রয়োজন। কারণ ছোট ছোট অসংখ্য মানবশিশুর কিচির-মিচির হইচই এর মাঝে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও অবস্থান করতে হয়। তাই তাদের মস্তিষ্কের বেশি বিশ্রাম প্রয়োজন। ৭৫ দিন ছুটি নিয়েই সংশ্লিষ্টরা ধোকাবাজির আশ্রয় নিয়ে শিক্ষকদেরও সরকারি কর্মচারীদের প্রদত্ত আর্থিক সুবিধাসহ ছুটি ভোগের অধিকার ক্ষুন্ন করছে। প্রাথমিক শিক্ষকেরা বেশি ছুটি চায় না। অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর মত ৩ বছর অন্তর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চাই।

প্রত্যেক মানুষ জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কিছু না কিছু পরিকল্পনা করে থাকেন। পেশাজীবী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকেরাও এর ব্যতিক্রম নন। লক্ষ্যে সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হচ্ছে পরিকল্পিত কাজ, কাজ এবং কাজ। মানবজাতি তার কাজের মাধ্যমেই গুহাজীবন ত্যাগ করে আজকের সভ্য জীবন তথা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এর পিছনে কি শুধুই কাজের ভূমিকা ছিল? বিশ্রামও কিন্তু ভূমিকা রেখেছে। কাজের পাশাপাশি মানুষ তার চিত্তকে বিকশিত করতে নানা সময় নানাভাবে বিশ্রামের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কারণ পর্যাপ্ত বিশ্রাম পরবর্তী কার্য সম্পাদনকে সহজ করে এবং সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা যোগ করে। কবি যথার্থই বলেছেন-

“বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা
নয়নের অঙ্গ যেন নয়নের পাতা।”

বিশ্রাম কর্ম পরিকল্পনাকে নষ্ট করে না বরং কর্মস্পৃহাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণকে সহজসাধ্য ও আনন্দদায়ক করতে এবং নবোদ্যমে বিদ্যার্জনে ব্রতী হতে বিদ্যালয়গুলোতে ছুটির বিধান রাখা হয়েছে। কাজের গুণগত মান বিকাশে বিশ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রতি বছরের মত এ বছরও প্রাথমিকে ছুটির তালিকায় জাতীয় দিবসগুলোকে ছুটি দেখিয়ে বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছুটি দেখানোর ফলে শিক্ষকেরা দায়সারাভাবে উক্ত দিবসগুলো পালন করে থাকেন। যার ফলে আগামী প্রজন্ম দেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যথাযথভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পাচ্ছেনা। দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি সঠিকভাবে জানতে না দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। এ প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্রুয়ারি, শহিদ দিবস, জাতির জনকের জন্মদিবস, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবসকে কর্ম দিবস হিসেবে দেখানো হোক। এতে সকল শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বাঙ্গালী জাতীর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। শিক্ষকদেরও দায়সারা যেনতেনভাবে জাতীয় দিবসে বাধ্যতামূলক উপস্থিত হয়ে পালন করার সুযোগ থাকবে না। প্রতি বছরই ছুটির তালিকা নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে থাকে।

অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ ব্যাপারে লেখালেখি ও আলোচনার পরেও জাতির ও প্রাথমিক শিক্ষার ঘৃণ্য শত্রুরা কানে সীসা দিয়ে বেশ দিবা নিদ্রায় মগ্ন থাকে। তারা প্রাথমিক শিক্ষকদের অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের মতো ৩ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদনভাতা পাওয়ার অধিকার হরণ করে যাচ্ছে। অথচ ছুটির তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষকেরা ৩বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদনভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সরকারি কর্মচারীরা ৩ বছর পর পর ১৫ দিনের ছুটিসহ ভাতা পান। সেখানে ৭৫ দিনের ছুটির মধ্যে ১৫ দিনের গ্রীষ্মের ছুটি রাখা কী অযোক্তিক ? প্রাথমিক শিক্ষকেরাতো ৭৫ দিনের বেশি ছুটি দাবী করেনা। অন্যান্য বছরের মত এবছরেও প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রীষ্মের ছুটি রাখা হয়েছে ৫ দিন । এটা শিক্ষা তথা শিক্ষকবান্ধব সরকারের সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরত্ব তৈরি করে রাখার ঘৃন্য চক্রান্ত। এ প্রেক্ষাপটে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ১৫ দিন রাখার লক্ষ্যে ৬ টি জাতীয় দিবসকে কর্মদিবস দেখিয়ে ৬ দিন যোগ করা হলে ১১ দিন হবে । তার সাথে শীতকালীন অবকাশসহ যেকোন গুরুত্বহীন ছুটি থেকে ৪ দিন ছুটি সমন্বয় করা যেতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষকদের যথাসময়ে শ্রান্তিবিনোদন ভাতা প্রাপ্তির অধিকারও লঙ্গন হয় না। এ বিষয়ে মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১ম গণশুনানীতে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়।

প্রধান শিক্ষকদের হাতে বিগত বছরগুলোতে ৩ দিন সংরক্ষিত ছুটি রাখা হয়। এ বছর রাখা হয়েছে ১ দিন। তাও ছুটির তালিকায় প্রধান শিক্ষকদের হাতে লিখে, নিচে থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসার অনুমোদন নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সংরক্ষিত ছুটি প্রধান শিক্ষকদের হাতে রাখার উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিক আকস্মিক কোন ঘটনা বিশেষ কারণে যাতে প্রধান শিক্ষক ছুটি দিতে পারে। অনুমোদন নিতে হলে প্রধান শিক্ষকের হাতে সে ছুটি কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিক টেলিফোনে বা পরে অবহিত করা যেতে পারে। সংরক্ষিত ছুটি কমানো ও কেড়ে নেওয়া মর্যাদা হানিকর। পূর্বের ন্যায় সংরক্ষিত ছুটি না রাখার কারণ বোধগম্য নহে।

সরকারি কর্মচারীদের মত প্রাথমিক শিক্ষকদের ১৫ দিনের শ্রান্তিবিনোদন ছুটি, ২ টি অর্জিত ছুটি,পি. আর. এল. পূর্নবেতন, ল্যাম্পগ্রান্ট ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তির জন্য মহামান্য সুপ্রিমকোর্টে প্রাথামিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম রিট আবেদন করেছেন। রিটের প্রাথমিক শুনানীতে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট সরকারের ওপর রুল জারি করছেন। আশাবাদী খুব শীঘ্রই চূড়ান্ত শুনানী শেষে প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারীর মত সুযোগ সুবিধা লাভ করবে। রিটের চুড়ান্ত শুনানীর সময়ক্ষেপন যেন যন্ত্রনাদায়ক।

হিসাবান্তে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম ছুটি ভোগ করে যাচ্ছে। সরকার ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলের বদলীর ধারা বাতিল করে শহরের শিক্ষকদের পদোন্নতি ও তাঁদের সন্তানদের পোষ্য কোটায় শিক্ষকতায় নিয়োগের অধিকার বিলম্বে হলেও রক্ষা করেছেন। শিক্ষাবান্ধব সরকার ছুটির তালিকা সংশোধনপূর্বক সরকারের আর্থিক খরচবিহীন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকার সংরক্ষণ করবেন এটা প্রত্যাশিত। শিক্ষকেরা পাবে সরকারি কর্মচারীদের মত বিধি মোতাবেক শ্রান্তিবিনোদন ভাতা পাওয়ার অধিকার।

আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে জাতীয় সংস্কৃতি ও দেশের ইতিহাস। এ ব্যাপারে ছুটির তালিকা সংশোধনের নিমিত্তে এক হয়ে আন্দোলন করার আহ্বান জানিয়েছে প্রাথামিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম। প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরামের সাথে কোন সংগঠনের বৈরিতা নেই। “সংগঠন যার যার অধিকার সবার” মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী সংগঠনটি। যেখানে শিক্ষার্থী তথা শিক্ষকের অধিকার ক্ষুন্ন হবে, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম উপস্থিত হবে। এ আন্দোলন শিক্ষক শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষার। আজ কতিপয় নেতাদের ব্যক্তিগত তদবিরের পেছনে অর্থের বিনিময়ে সময় দিতে দেখা যাচ্ছে।

যেসব সংগঠনের শিক্ষকদের অধিকারের প্রশ্নে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ আছে, তাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। আশা করি শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাঝে খুব শীঘ্রই ছুটির তালিকা সংশোধনের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এ ছুটির তালিকা প্রতিবছরই শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষোভ প্রশমিত না করলে লাভবান হবে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দোসররা।

সর্বশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন, দেশ ও জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী চক্রান্ত থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে রক্ষা করুন। প্রাথমিক শিক্ষকদের, বর্তমান সরকারের শিক্ষায় বিশাল অর্জন জনগনের মাঝে আন্তরিকভাবে প্রচারের সুযোগ দিন। প্রাথমিক শিক্ষকদের ভালবাসা গ্রহণ করুণ। সঠিক পথে এগিয়ে যাক শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনার স্বপ্ন। এ প্রত্যাশায়।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.022925138473511