একটি বই একজন লেখকের আহরিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং জীবনদর্শনের সমষ্টি। নিউটন, গ্যালিলিও, আইনস্টাইন কিংবা রবীন্দ্র, নজরুল, সকল জীবিত কিংবা গত কিংবদন্তিদের কিংবদন্তি হওয়ার পিছনে একটাই গল্প। আর সেটি হলো বই পড়া।
বই প্রবাহমান মহাসমুদ্রের মতো চতুর্দিক থেকে আহরিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও আইডোলজিকে একীভূত করে কাগজের পাতায় মুড়িয়ে আবদ্ধ করে রাখে। যে কোনো মুহূর্তে আছড়ে পড়তে পারে যুগান্তকারী জলোচ্ছ্বাস তবে সেটা প্রলয়ঙ্করী নয় পরিবর্তনকারী। সেটি পরিবর্তন করে আমাদের মননশীলতা ও চিন্তা-চেতনার জগেক। আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে জীবনদর্শনে। উন্মুক্ত করে মুক্তবুদ্ধি চর্চার দ্বারকে। বৃদ্ধি করে সৃজনশীলতা ও নৈতিকতা। বাধা-বিপত্তি এবং নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ আমাদের জীবন। ইচ্ছা করলেই সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। এগুলোকে জয় করতে হয়। এই জয়ের শিক্ষা আমরা পেয়ে থাকি আমাদের সচেতন পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বই থেকে। আমাদেরকে পরাজিত হয়ে পিছনে তাকাতে হয় না। প্রতিটি পদক্ষেপে বিজয়মাল্য নিয়ে ঘরে ফেরার প্রেরণা পাই বই থেকে। যুগ যুগ ধরে জীবন যাপনের দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো, প্লেটোর রিপাবলিক, এরিস্টটলের পলিটিক্স, কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল, পাওলো কোয়েলহোর আলকেমিস্ট।
জগতের মহান ব্যক্তিরা সবাই বইপ্রেমী। রবীন্দ্রনাথ ‘ঐকতান’ কবিতায় তাঁর মহান কীর্তির রহস্য উন্মোচন করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী কুড়াইয়া আনি’। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী বিল গেটস বছরে শতাধিক বই পড়েন, ওয়ারেন বাফেট প্রতিদিন একটি করে বই পড়েন। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল বই।
এবার আসি কী বই পড়ব আর কী বই পড়ব না। এ প্রসঙ্গে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ মানা করেছেন বটতলার বাজে উপন্যাস পড়তে। প্রমথ চৌধুরী বইকে দুভাগে ভাগ করেছেন : ১. পঠিত বই তথা সবধরনের সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দর্শনের বই এবং ২.অপঠিত বই তথা একাডেমিক বই। কেননা একাডেমিক বইগুলো আমাদের ধ্যানধারণাকে সংকুচিত করে দেয়, জ্ঞানের বিশাল জগেক আড়াল করে রাখে। আমরা প্রতিনিয়ত কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য তোতা পাখির মতো গাইড বইয়ের প্রশ্নোত্তর এবং গরু রচনা মুখস্থ করে আমাদের মহামূল্যবান সময় ও প্রতিভাকে ধ্বংস করতে থাকি। অতএব আমাদের উচিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানের মহাসাগরে বিচরণ করা।
শিক্ষা আজ জ্ঞানার্জন নয়, চাকরি অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। মহাজ্ঞানীদের রেখে যাওয়া জ্ঞানের ভাণ্ডার বহনকারী বইগুলোতে মরচে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তার করছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের শিটগুলো! গবেষণাগারগুলো বদ্ধঘরে পরিণত হয়েছে যেখানে মাকড়শা জাল ছড়াচ্ছে আর ইঁদুরেরা বংশ বিস্তার করছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে হবে। প্রায়োগিক/ব্যবহারিক শিক্ষার বিস্তার করতে হবে। সিভিল সার্ভিস নীতিমালা সংস্কার করতে হবে। (পদার্থবিজ্ঞানীরা পুলিশ ক্যাডার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্য ক্যাডার, মেডিক্যাল ডাক্তাররা ফরেন ক্যাডার, মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা কাস্টম অফিসার এবং কেমিস্ট্রি পড়ে যেন কেউ ব্যাংক অফিসার না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে)।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করতে হবে। গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
সর্বোপরি বইকে নিত্যসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করা চাই। এ পৃথিবী বইয়ের হোক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়