প্রাণীকূল, জীব-জগৎ তথা প্রকৃতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় তথা সুস্থতার সঙ্গে জীবন ধারনের জন্যই প্রয়োজন সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের। প্রাকৃতিক ভারসাম্য মানুষ তথা সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত অপরিহার্য। আর এ ভারসাম্য বজায় রাখতে সঠিক সংখ্যায় সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
জৈব পরিবেশের পাশাপাশি ভৌত পরিবেশও প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতিসমূহের বেঁচে থাকার উপযোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি প্রকৃতিকে পঙ্গু করে দেয়। তবে এই বিলুপ্তি প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে ঘটলে তাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যে তেমন কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু এতে যখন মানুষের হাত পড়ে তখনই তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
জীব জগতে যখন প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়, তখন তারা এমন সব কাজ করে যা তার চারপাশের জগৎকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেয় না। মানুষের কথাই আগে বলা যাক। একটি দেশের মানুষের সংখ্যা যখন বেড়ে চলে তারা তখন নানা রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বাড়তি মানুষের জন্য বাড়তি খাবারের দরকার পড়ে। তাই তারা উচ্চফলনের ধানের চাষ করে থাকে। এর হাত ধরে আসে সার, বীজ, কীটনাশক আরও কত কি! চাষের জমি বাড়াতে, মানুষের পড়তি জমিতে বাড়ি তৈরিতে কাটতে হয় বন। এতে হুমকির সম্মুখীন হয় বন্যপ্রাণী। বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যায় কার্বন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওজন স্তর ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যায় বেড়ে। বাড়তি মানুষের চাহিদা কেবল খাদ্যে সীমিত নয়, তাদের জন্য পণ্য সামগ্রীর সরবরাহও বাড়াতে হয়। ফলে গড়ে ওঠে নতুন নতুন কল-কারখানা, ইঞ্জিন চালিত নানা প্রকার যানবাহন। এসব কল-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য আর যানবাহনের কালো ধোঁয়া দূষিত করে পরিবেশ।
আমরা প্রতিদিন চারপাশেই জমিয়ে তুলছি আবর্জনার স্তূপ। দিনে দিনে জমে ওঠা এসব আবর্জনা আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করছে। মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যান্য দূষণের সাথে পলিথিনরূপী মারাত্মক দূষণ যোগ হয়েছে। এটা পচে মাটিতে মিশে যেতে প্রায় ৪০০ বছর লাগে। জমিতে ফসল উৎপাদনে বাধার সৃষ্টি করে। মাটির ওপর আস্তরণ পড়ছে। অচল করে দিচ্ছে নর্দমা ও পয়ঃনিষ্কাশনের পথগুলো। ফলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। পলিথিন ও কঠিন বর্জ্যগুলো নদী দিয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। ফলে নদী ও সাগরের মাছ ও অন্যান্য প্রাণী দারুণ বিপদে পড়ছে।
রাসায়নিক বর্জ্যও মাটির অশেষ ক্ষতি করছে। মাটি তার উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। মাটিতে যেসব প্রাণীর বাস এবং যেসব প্রাণী মাটির ওপরে বসবাস করে তাদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। মূলত কৃষি ও শিল্প থেকে যে রাসায়নিক বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা মৃত্তিকা দূষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয় ষাটের দশকে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদন বাড়াতে এ কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েই যাচ্ছে। কীটনাশক শুধু ক্ষতিকারক কীটকেই বিনাশ করছে না, শেষ করছে উপকারী কীটপতঙ্গকেও। উন্নত বিশ্বে কিছু কীটনাশক মানুষ ও প্রাণীর ক্ষতি করে বলে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। অথচ সেসব ক্ষতিকারক কীটনাশক আমাদের দেশে দেদার ব্যবহার হচ্ছে। কীটনাশকের সাথে আগাছানাশক ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোর ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে বালাইনাশক ব্যবহার করা উচিত, যা স্বাস্থ্যের ও মাটির জন্য ভালো।
শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়া উঠছে অনেক উপরের আকাশে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো সে ধোঁয়া বৃষ্টির পানিতে মিশে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকেই। বিষিয়ে দিচ্ছে নদী ও হ্রদের পানি, ধ্বংস করছে বনভূমি, ঘর ছাড়া করছে যেসব প্রাণী বনে বাসা বাঁধছে তাদের। বিষাক্ত ধোঁয়া মেশানো এই বৃষ্টিই পরিচিত এসিড বৃষ্টি হিসেবে।
পৃথিবীর চারপাশের বায়ুর বিশাল ভাণ্ডার দূষিত হচ্ছে আরও নানা কারণে। অসংখ্য যানবাহন বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে কার্বন-মনো-অক্সাইড ও হাড্রোকার্বন নামে বিষাক্ত গ্যাস। এসব গ্যাস সবচেয়ে ক্ষতি করছে মানুষের। এতে শ্বাসজনিত রোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ পর্যন্ত হতেপারে। যানবাহন ও কারখানাগুলো থেকে বেরিয়ে আসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন-মনো-অক্সাইড।
আমরা জানি, শক্তির একটা প্রধান উৎস হলো কয়লা। নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইড উৎপন্ন হয় কয়লা পোড়ানো থেকে। এগুলো বাতাসকে দূষিত করে। নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতায় যথাক্রমে নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিডে পরিণত হয়। শীত কালে ধোঁয়া ও কুয়াশা একসাথে মিশে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয় তা-ও যানবাহন থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া ও হাইড্রো কার্বন থেকেই সৃষ্টি হয়। শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণের একটি বড় কারণ। দুনিয়ার শিল্পায়িত দেশগুলোতে এসিড বৃষ্টি জলজ প্রতিবেশকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসিড বৃষ্টি বনভূমি নষ্ট করারও কারণ বটে।
পানির অপর নাম জীবন বলা হলেও মানুষ পানিকে ঠেলে দিচ্ছে বিপদ থেকে মহাবিপদের দিকে। অন্য কথায় মানুষ নিজেই তৈরি করছে নিজের জন্য সমস্যা। আর এ বিপদ তৈরি হচ্ছে অর্থনেতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। পানি দূষণ আজকে আমাদের জন্য একটি মহাভাবনার কারণ। আমরা মহাসাগর নামের যে বিশাল জগতের কথা বলি, সে জগৎটিও আজ সমস্যার মুখোমুখি। নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্প বর্জ্য দ্রুত বেড়ে চলেছে। এসব বর্জ্য নদীতে এবংনদী থেকে সাগরে পতিত হচ্ছে। ফলে বেলাভূমিতে ও সাগর তীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যাচ্ছে। জলযানও দূষিত করছে নদীর পানি। জলযান থেকে নদীতে নিক্ষেপ করা বর্জ্য বিষাক্ত করছে পানিকে। এটা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর রোগের কারণ হচ্ছে।
তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়লে তেল ছড়িয়ে পড়ে নদী ও সাগরে। এ ধরনের তেল নদীর উপরিস্তরে ভেসে থাকে। ফলে নদী ও সাগরের প্রাণী, বিশেষ করে পাখি ও নদীর মাছ মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া জাহাজগুলো বন্দরে ভেড়ার পর তার বর্জ্য নদীতে ফেলে। এ বর্জ্য দূষিত করছে নদী ও সাগরের পরিবেশ।
আজ সারা বিশ্বের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। হিমালয় ও মেরু দেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, প্লাবন ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এখন আরব দেশের মতো মরুভূমিতে পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিতে বন্যা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপকে প্রবল তুষার ঝড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। অথচ দুই দশক আগেও এ অবস্থা ছিল না। আর এর জন্য অন্য গ্রহের কোনো কিছু নয়; মানুষের কর্মকাণ্ডেই এই মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এর সমাধান মানুষেরই হাতে। তারা যদি ভোগবাদী চাহিদা কমিয়ে আনে, তাহলে ফার্নেস তেল পোড়ানো কমেযাবে, কার্বন নির্গমন কম হবে। বিশ্বের আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে। মানুষের রোগব্যাধি কমে যাবে। সারা বিশ্বে সবাইকে বাঁচাও, বাঁচতে দাও নীতিতে অটল থেকে কাজ করতে হবে। শুধু ইউরোপ, আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না; উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোকেও আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষত ভারত, চীন ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে খনিজ তেল পোড়ানো কমাতে হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু ঠিক রাখার জন্য আমাদের প্রচুর বনায়ন করতে হবে।
লেখক : সুমাইয়া আক্তার, অনার্স ৪র্থ বর্ষ, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]