সিভিল সার্ভিসের নিয়োগে কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি উঠে যাওয়াটি যে বহু মানুষই ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন, সেটি অনুমান করা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হওয়া একটি নিয়ম সম্পূর্ণরূপে উঠে গেলে তার একটা প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে সমাজে। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে চলে আসা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে সেটিই স্বাভাবিক। এর সুফল বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। কোটা তুলে নেয়ার জন্য ছাত্রদের পক্ষ থেকে আন্দোলনও হয়েছিল। তবে সেটি ছিল কোটার পরিমাণ দশ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে। পেছনের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিভিল সার্ভিসের নিয়োগে বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশনের এ নীতিমালা নিয়ে আলোচনাও কম হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নির্বাহী আদেশ জারি করে সর্বপ্রথম কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। তখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নেয়া হতো মাত্র ২০ ভাগ। পরে ক্রমান্বয়ে সেটি বাড়ে। বিভিন্ন বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক মেধাবী উত্তীর্ণ হয়েও অতীতে একদিকে চাকরি পাননি, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। শনিবার (৪ জুলাই) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়কে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়কে আরও জানা যায়, প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড সরকারী কর্মকর্তা নিয়োগে এখন থেকে আর কোন বিসিএসের ফল প্রকাশে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে না, এ সিদ্ধান্তকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দেবে প্রকৃত মেধাবীরাই। মঙ্গলবার প্রকাশিত ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে সর্বশেষ কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে ২০১৮ সালের জুন মাসে একটি কমিটি করে সরকার। অষ্টম থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোটা থাকবে না বলে গত ২০ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রিসভা। তবে কোটা যুগের অবসানের বিষয়টি পরিষ্কার হলো মঙ্গলবার পিএসসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকেই। এতদিন সরকারী চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাঁচ শতাংশ, প্রতিবন্ধী এক শতাংশ। তবে এমনটাও দেখা গেছে কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় সবশেষে বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় শূন্যপদগুলোতে মেধাবীরাই স্থান পান।
প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা বিবেচনা অবশ্যই ভাল পদক্ষেপ। দেশে প্রতিবছরই উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে শ্রমবাজারে প্রবেশের অপেক্ষারত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। সেখান থেকে সবচেয়ে মেধাবীরা সরকারী চাকরিতে এসে দেশসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক- এমন ভাবনাও ইতিবাচক। শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কিংবা বাঙালী-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এমন ভেদাভেদ বা বৈষম্য আর নেই। তাই মেধার ভিত্তিতে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ সন্দেহাতীতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ। তবে যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেসব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বিশেষ সুযোগ তথা কোটা না থাকার বিষয়টি সর্বজনের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সেটি এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের জন্য অন্তত কিছুটা সুযোগ সমীচীন কিনা সেটি ভেবে দেখার আবেদন উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আরেকটি বিষয় হলো প্রতিবন্ধীরা শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমাজে কিছুটা যে পিছিয়ে থাকে, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী পর্যায়ে তাদের কাজের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানটিতে রাষ্ট্রের একটা কর্তব্য নিশ্চয়ই থাকে। তাই এ বিষয়টিও বিবেচনার অবকাশ রয়েছে।