বিসিএস ক্যাডার হয়েও যে কারণে আন্দোলনে শিক্ষকগণ - দৈনিকশিক্ষা

বিসিএস ক্যাডার হয়েও যে কারণে আন্দোলনে শিক্ষকগণ

জিনান বিনতে জামান |

মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্যে, আমার জন্মের জন্যে আমি আমার পিতা-মাতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমার মনুষ্যত্বের জন্যে, কৃতিত্ব, বীরত্ব ও গৌরবের জন্য ঋণী আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে।’ শিক্ষকতা এমনই এক পেশা। এ জন্যেই শিক্ষকদের বলা হয় ‘সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ বা সমাজ নির্মাণের স্থপতি। আমাদের দেশে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য নিয়মের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া অন্য স্তরে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের পদের জন্য।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত আদেশ বলে এ সার্ভিসে উত্তীর্ণ যে ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার ব্রত বা সাধনার সাথে তার ওপর আরো আরোপিত হয় মহান রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দায়িত্ব। কিন্তু ‘শিক্ষকতা শুধু পেশা বা বৃত্তি নয়, এটা এক মহান ব্রত’ এ কঠিন সত্য উপলদ্ধিকারী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে সময় পার করছেন। ক্লাস পরীক্ষার বাইরেও তারা সভা-সমাবেশ করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে-কেন?

হ্যাঁ, কারণতো একটা অবশ্যই আছে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় মেধা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রমাণ দিয়েই একজন ছাত্র ক্যাডার সার্ভিসের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ক্যাডারে প্রবেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সামান্যতম পথ না হেঁটেও অনেকেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হচ্ছেন। কারণ, একমাত্র এ ক্যাডারেই রয়েছে ১০% এর নামে কিংবা প্রদর্শক (ডেমোনেস্ট্রেটর) থেকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ক্যাডারভুক্ত হওয়ার সুযোগ। এসব পার্শ্ব-প্রবেশ প্রক্রিয়ার জন্য প্রকৃত বিসিএস ক্যাডাররা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তার ওপর রয়েছে বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণের ফলে আত্মীকৃত ক্যাডার (!)দের বিশাল স্রোত।

স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যারা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন দুই চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনেকেই হয়তো বিসিএস ফরম পূরণের কথা কখনো চিন্তাও করেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ফলে সেখানকার চেয়ার, টেবিল, বোর্ড বা বেঞ্চের মতই তারাও জাতীয়কৃত হয়ে ক্যাডার মর্যাদা লাভ করেন। এর যৌক্তিকতা অবশ্যই প্রশ্ন সাপেক্ষ। বাড়ির পাশের কলেজে যে কোনোভাবে শিক্ষক হিসেবে প্রবেশের পর সে কলেজ জাতীয়করণ করায় যে কেউ যদি ক্যাডার সদস্যভুক্ত হন তাহলে এত আয়োজন করে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে শুধুমাত্র পর্যাপ্ত পদ না থাকায় বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মেধাবীদের নন-ক্যাডার হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করে নিয়ে নিয়োগের সুপারিশে অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে।

তবে জাতীয়করণ নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। শিক্ষার বিস্তার ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি সরকারের আমলেই কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হলেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাজে ও মনোজগতে। স্বভাবতই দেশের হাজারো মেধাবীর মধ্য থেকে যাচাইকৃত মেধার স্বাক্ষর রেখে ক্যাডারভুক্ত হওয়া একজন শিক্ষক আর জাতীয়করণের স্রোতে ভেসে আসা একজন শিক্ষকের মর্যাদা কখনো সমান হতে পারে না। জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় পূর্বে স্বপদে আত্মীকরণের ফলে প্রকৃত বিসিএস শিক্ষকরা যারপরনাই বঞ্চনার শিকার হতেন। অনেক সময় আত্মীকৃত অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে বহু বিসিএস শিক্ষককে, যার জন্য জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের হীনমন্যতাই দায়ী। বিধি-২০০০ কে এক্ষেত্রে বিসিএস ক্যাডার শিক্ষকদের রক্ষাকবচ বলা যেতে পারে। এ বিধি মোতাবেক কোনো বছর জাতীয়কৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক (তিনি অধ্যক্ষ হলেও) সে বছর নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের পেছনে অবস্থান করবেন। এর ফলে ক্যাডার মর্যাদা কিছুটা সমুন্নত থাকলেও এখনো তা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত নয়। বর্তমানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে পনের হাজার সদস্য রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই এ সুযোগে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ক্যাডারে আত্মীকরণের অপেক্ষায় রয়েছেন। যেখানে প্রকৃত শিক্ষকের সংখ্যা হয়তো নগণ্য।

সঙ্গত কারণেই আজ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা প্রতিবাদমুখর। তরুণ শিক্ষকরা আজ `NO BCS, NO CADRE`স্নোগানে মুখর ও ঐক্যবদ্ধ। সকলের দাবি কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হোক, কিন্তু সেখানকার শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হবেন না। এ দাবির প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে এই ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণের বিষয়টি উপস্থাপন করেছে, যা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মাঝে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করছে।

কলেজ জাতীয়করণ হোক, কিন্তু শিক্ষকরা ক্যাডার হবেন না এই দাবিতে এবং বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে আগামীকাল ২৪ নভেম্বর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। সারাদেশ থেকে ক্যাডার শিক্ষক-কর্মকর্তারা এ সমাবেশে যোগ দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অতীতে বেতন ভাতার দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে এসে পুলিশী নির্যাতনে শিক্ষক মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এবার কিন্তু কোনো বেতন ভাতার জন্য নয়, বিসিএস শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন স্বীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য। দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল অনেক সময় আক্ষেপ করেন যে, মেধাবীরা এখন আর শিক্ষকতায় আসছেন না। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ ক্যাডারের শিক্ষক হয়েও যেখানে আত্মীকৃতদের দাম্ভিকতায় মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয় সেখানে মেধাবীরা দিন দিন শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাবেন এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

লেখক: প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043179988861084