আজকাল পত্র-পত্রিকাসহ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের দিকে তাকালে দেশের উন্নয়নের খবরের পাশাপাশি বেশকিছু নেতিবাচক ঘটনার খবরও আমাদের চোখে পড়ে। গণমাধ্যমে যা প্রকাশিত বা প্রচারিত হয় তার সবই যেমন সর্বাংশে সত্য নয়; আবার সবকিছু মিথ্যা বা বানোয়াট- এমন কথাও বলা যাবে না। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
গণমাধ্যমে বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য (অনেক সময় ছবিসহ) কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তথ্য-উপাত্ত ও ছবিসহ প্রচারিত কিছু ঘটনা আজকাল আমাদের বড় বেশি চিন্তিত করে তুলছে। সেসব খবরাখবর পড়ে-শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, যারা এখন বড় বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, তারা কি সবকিছু দেখেন বা শোনেন?
তারা যা করছেন, যা বলছেন, সেসবে কি যথেষ্ট যুক্তি আছে? তারা বা আমরা যেসব ভুল করছি তার ভবিষ্যৎ প্রভাব-ফলাফলের কথা কি কেউ একবারও ভাবছেন?
৮ সেপ্টেম্বর এবং তার পরেও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি ঘটনা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও দেশবাসীকে যেন একটু বিচলিত করে তুলেছে। একটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ২ কলামব্যাপী প্রতিবেদন হিসেবে; অন্য ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে অন্য একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শেষ পাতায় সিঙ্গেল কলাম প্রতিবেদন হিসেবে।
একটি খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয় নিয়ে; অন্য খবরটি রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের আলোচিত বালিশ নিয়ে এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দা ক্রয় বিষয়ে।
একটি দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম হচ্ছে- পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ডাকসু নেতা। খবরটির সারকথা হচ্ছে- দীর্ঘ সময় পর এ বছর মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধরে নেয়া হয়েছে, এ নির্বাচনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ভোট প্রয়োগ করে ডাকসুতে নেতৃত্ব নির্বাচিত করেছে।
মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র ৬ মাস পার হতে না হতেই উল্লিখিত পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ডাকসু নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের ভর্তি বিজ্ঞাপন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই ৩৪ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি বিভাগে ভর্তি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৮ জন ডাকসু ও হল সংসদে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে।
তাদের অনেকে আবার নির্বাচনে অংশ নেয়নি, আবার কেউ কেউ নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচিত হতে পারেনি।
এ খবরটি থেকে আমরা জেনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর নিয়মিত ভর্তি শেষ হয়েছিল এ বছরের জানুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারি মাসে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এসব শিক্ষার্থী নাকি কোনো ধরনের লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিনের ‘চিরকুটে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি বিভাগের ছাত্র হতে পেরেছে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের কাছে ওই পত্রিকার সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিয়েছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তির ব্যাপারে তার জানা আছে; সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রামের ভর্তির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
উপাচার্য মহোদয়ের এ উত্তর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক তা ভাবার অবকাশ রয়েছে। সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা ঢাবির সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে সাংবাদিককে সংশ্লিষ্ট ডিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন।
আর ওই সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট ডিন মহোদয়কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, এ সাংবাদিক নাকি কিছু একটা লিখে তাকে ‘ম্যালাইন’ করতে চাচ্ছে, সে কারণে তিনি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতেই রাজি নন। সাংবাদিকের পেশাগত কাজই হচ্ছে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে মানুষকে তা জানানো। তাহলে এ ক্ষেত্রে ‘ম্যালাইন’ করার কথা উঠছে কেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আমি বিগত ৩০-৩২ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও কখনও নিয়মের ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা নয়। তবে অন্য যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ টু জেড সব সদস্য, এমনকি দেশবাসীর কাছে একটা বিষয় আজও পরিষ্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে ভোট অনুষ্ঠান- এ দুটি জায়গায় ট্রান্সপারেন্সির কোনো ঘাটতি নেই।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে পত্রিকায় এই যে খবর বেরিয়েছে তা আমাদের রীতিমতো দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা আশা করি, গণমাধ্যমে যে খবর এসেছে- এ বিষয়ক সব তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করবেন।
বর্তমান উপাচার্য মহোদয়সহ অন্তত সিনিয়র শিক্ষকদের মনে আছে, সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করা কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনার দিন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা।
যতদূর মনে পড়ে, দেশের বিভিন্ন বোর্ড থেকে প্রায় ২০ জন (বা তারও বেশি হতে পারে) মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ জনের একটা তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে উপাচার্য বরাবর পাঠানো হয়েছিল। সেদিন দেখেছিলাম, উপাচার্য মহোদয় ওই তালিকা নিয়ে শিক্ষক সমিতির নেতা, বাণিজ্য অনুষদের সিনিয়র শিক্ষক এবং ডিন মহোদয়কে কত অনুনয়-বিনয়ই-না করেছিলেন; কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি।
বিষয়টি সেসময় একাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপন করা হয়েছিল। একাডেমিক কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের চিঠিকে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিল।
ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ওই বছর কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। অবশ্য একজন বা দু’জন মাত্র শিক্ষার্থী ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। শিক্ষকরা সেদিন বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হবে; কারও ইচ্ছানুযায়ী নয়।
পরে অবশ্য সেসময়ের সরকারও এ ইস্যু নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি। আমরা আশা করব, বর্তমান উপাচার্য এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মহোদয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ভর্তির এ বিষয়টি পরিষ্কার করবেন; যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে আসলেই কেউ ‘ম্যালাইন’ করতে না পারে।
পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় খবরটি হচ্ছে- রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের বালিশ এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে পর্দা ক্রয়সংক্রান্ত। এ ঘটনা দুটি বেশ আগের হলেও ঘটনাগুলো এখনও বারবার আলোচনায় আসে। ব্রিজ বা ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার, সরকারি প্রকল্পে কেনাকাটায় দুর্নীতি- এসব কারণে সরকারের অনেক ভালো কাজের সুনামও আড়াল হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বালিশ-পর্দা ক্রয়ের ঘটনাকে ছিঁচকে চুরি বলে অভিহিত করেছেন। উল্লিখিত ঘটনাগুলো নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও বড় সাহেবরা এসবকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এসব ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে বা এ ধরনের কাজকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের ব্যাপারে জনগণের প্রশ্নগুলো শুনতে বড় সাহেবদের অনুরোধ জানাচ্ছি।
ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়