গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কের আবর্ত থেকে বের হতেই যেন পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। স্বাভাবিক কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ জাতিকে প্রভাবিত করে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩' অনুসারে। এ অধ্যাদেশ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রধান আটটি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সিনেটের নাম রয়েছে সবার ওপরে। সিনেটের প্রধান কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণয়ন, সিন্ডিকেট প্রস্তাবিত আইনের অনুমোদন এবং উপাচার্য নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি করা।
এই অধ্যাদেশের আর্টিকেল ১১ (১) অনুসারে রাষ্ট্রপতি সিনেট মনোনীত তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে চার বছর মেয়াদের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে থাকেন। এ ছাড়া কোনো কারণে (ছুটি, অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণ) উপাচার্যের পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি ১১(২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে যাকে তিনি যোগ্য মনে করেন, তেমন একজনকে উপাচার্য হিসেবে সাময়িকভাবে নিয়োগ দিতে পারেন। রোববার (৪ আগস্ট) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মো. আবদুর রহিম।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজকে অব্যাহতি প্রদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ এর ১১ (২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে 'তিন ব্যক্তির প্যানেল হতে উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত' অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে 'সম্পূূর্ণ সাময়িকভাবে' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব প্রদান করেন।
সাময়িকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ টার্ম (৪ বছর) অতিক্রম করারও ৭ মাস পর তিনি ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচন করেন। সেই প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি ২৫ আগস্ট ২০১৩ তারিখে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ এর ১১ (১) অনুযায়ী চার বছর মেয়াদের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ লাভের জন্য তিনি আরেকবার অপূর্ণাঙ্গ সিনেটের মাধ্যমে ২৯ জুলাই ২০১৭ সালে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশন আহ্বানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১১ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট (যাদের মধ্যে লেখক নিজেও ছিলেন) হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটকারীদের যুক্তি ছিল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩-এর আর্টিকেল ২০ (১) অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট বলতে ১৩টি ক্যাটাগরিভুক্ত ১০৫ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত সিনেটকে বোঝায়। সিনেট পূর্ণাঙ্গ না করে সিনেটের অধিবেশন ডাকার এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ১০৫ জন সিনেট সদস্যের মধ্যে ৬০ জন প্রতিনিধি সরাসরি ভোটে (শিক্ষকদের ৩৫ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারা এবং ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের দ্বারা) নির্বাচিত হন (বর্তমানে ৪৪ হাজার রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট রয়েছেন)। সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এ প্রতিষ্ঠানে দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সিনেটে মনোনীত সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটরা প্রাক্তন ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডাকসু মনোনীতরা বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করেন। এভাবে শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক, সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এ সিনেটের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হলে গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে; সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত থাকবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালের পরিক্রমায় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত। কাজেই সিনেটের ১৩টি ক্যাটাগরির একটিও খালি থাকলে সিনেট অধিবেশন আহ্বান করা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। বিজ্ঞ আদালত পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক শুনে রুল নিষ্পত্তি করেন। আদালতের সিদ্ধান্ত রিটকারীদের অনুকূলে যায়। আদালত সিনেট পূর্ণাঙ্গ না করে ২৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান এবং এ অধিবেশনের মাধ্যমে গঠিত প্যানেলকে বেআইনি ও অকার্যকর ঘোষণা করেন।
একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্যকে ছয় মাসের মধ্যে সিনেট পূর্ণাঙ্গ করে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নের নির্দেশ প্রদান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণের পর ধাপে ধাপে সিনেটের সব ক্যাটাগরি পূর্ণ করেন। সর্বশেষ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর পর একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন করেন। এটি সবার কাছে প্রত্যাশিত ছিল যে, পূর্ণাঙ্গ সিনেটের মাধ্যমে তিনজনের মনোনীত একটি প্যানেলের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ অনুযায়ী প্যানেলের ক্রম সম্পর্কে কিছু বলা নেই। এর আসলে কোনো গুরুত্বও নেই।
অতীতে তিনজনের প্যানেল থেকে যে কোনো একজনকে উপাচার্য নিয়োগের একাধিক নজির রয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে অহেতুক বিতর্ক হচ্ছে। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে একটি গোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এ ধরনের পরিস্থিতির পেছনে শিক্ষকদের যে একেবারে দায় নেই, সে কথা বলব না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্বল হলে, প্রশ্নবিদ্ধ হলে কার কী লাভ, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। ভিসি প্যানেল নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, আমি মনে করি সেটিও অযৌক্তিক। এ বিষয়ে অনেকে সবিস্তার জানেন, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, আবার অনেকে না জেনে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।
৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের অধিবেশনটি ছিল একটি বিশেষ অধিবেশন। এ ধরনের অধিবেশনে উপাচার্যের অভিভাষণ থাকে না; কাজেই পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনাও হয় না। উপাচার্যের প্রধান কাজ হাউসের কাছে প্যানেল আহ্বান করা এবং তা আইনের বিধান অনুযায়ী সদস্যদের সম্মতিতে পাস করা। তাঁর আহ্বানে একজন সম্মানিত সদস্য তিনজনের একটি প্যানেল প্রস্তাব করেন। সভাপতি আর কোনো প্যানেল আছে কি-না- একাধিকবার জানতে চেয়েছেন। সেখানে অন্য কোনো প্যানেল বা অন্য কোনো নাম প্রস্তাব করা হয়নি।
এভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে তিনজনের একটি প্যানেল পাস হয়। কাজেই আইনের কোনো ব্যত্যয় না হওয়া সত্ত্বেও একটি বিতর্ক সিনেটের বাইরে পরে তৈরি করা হয়েছে। কেউ কোনো বিকল্প প্যানেল বা নাম প্রস্তাব করতে চাইলে সিনেট অধিবেশন কক্ষই ছিল তার জন্য যথাযথ স্থান। কেননা, ভিসি প্যানেল নির্বাচনের চূড়ান্ত এখতিয়ার সিনেটের। এখানে একটি বিষয় খুবই শঙ্কার; তা হলো দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি; পূর্বের উপাচার্যের সময়ে প্রায় সাড়ে আট বছর সিনেট অপূর্ণাঙ্গ ছিল। বর্তমান উপাচার্য যখন ডাকসু নির্বাচনের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং কর্ম সম্পাদন করে এবং সব ক্যাটাগরির সমন্বয়ে সিনেটকে পূর্ণাঙ্গ করে সিনেটের মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি করলেন, তখন বিষয়টিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্পাদক, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি