মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নানাজনের নানা কথা। নানা মুনির নানা মত। কেউ মাদরাসা শিক্ষার পক্ষে আর কেউ বিপক্ষে। তবে যে যাই বলুন না কেন, মাদরাসা শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা একদম অস্বীকার করার উপায় নেই। উপমহাদেশের শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক শতাব্দী ধরে মাদরাসা শিক্ষা কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতবর্ষে একটি স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত শিক্ষা ধারা।
যতদুর জানা যায়, মাদরাসা শিক্ষা দিয়েই উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুত্রপাত। সে জন্য ভারত উপমহাদেশে জায়গায় জায়গায় অনেক প্রাচীন মাদরাসা দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সুদূর অতীত থেকে সারা দেশে অসংখ্য মাদরাসা রয়েছে এবং বর্তমানেও নতুন নতুন মাদরাসা গড়ে উঠছে।
মুলত ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার এবং ইহ-পরকালীন শান্তির লক্ষ্যে মাদরাসা শিক্ষা চালু হয়। বর্তমান সময়ে মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ দেখা যায়। দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সন্তানরা যেহেতু মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, সেহেতু মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে আরো বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষা দু'টি ধারায় প্রচলিত। একটি সরকারি ধারা ও অন্যটি কওমি ধারা। বৃটিশশাসিত ভারতে ইংরেজ সরকারকর্তৃক কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপমহাদেশে সরকারি ধারার মাদরাসা শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। তবে এখনো দেশে কওমি ধারার মাদরাসার সংখ্যাই বেশি।
ভারতবর্ষে সম্ভবত দেওবন্দের দারুল উলুম মাদরাসার অনুসরণে উপমহাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ধারা চালু হয়ে অদ্যাবধি চলমান। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি প্রদান করে মাদরাসা শিক্ষায় একটি অসাধারণ মাইল ফলক রচনা করেছে। সরকারি অর্থে পরিচালিত বেসরকারি মাদরাসার আইসিটি শিক্ষকদের এমপিও দিয়ে সরকার মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের পথ প্রশস্ত করেছে। তদুপরি মাদরাসা শিক্ষার অধিকতর আধুনিকায়ন ও আরো যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি।
কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি দিয়েই সরকার যদি দায়িত্ব শেষ মনে করে তবে সে স্বীকৃতি কোনো কাজে আসবে না। কওমি মাদরাসার কারিকুলাম ও সিলেবাস ঢেলে সাজানোর তাগিদ দিতে হবে। এ ধারার শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে যুগোপযোগী করা হলে গোটা জাতি লাভবান হবে। এ ধারণাটি সর্বপ্রথম আলেম সমাজের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। কওমি ধারার মাদরাসা শিক্ষায় আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতি সামগ্রিক ভাবে লাভবান হওয়ার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হবে। কওমি ধারার অনেক আলেম এখনো সরকারের এ উদ্যোগকে সুনজরে দেখেন না। তাদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়া অপরিহার্য।
আমার বোধগম্য হয় না যে, এখনো অনেক কওমি মাদরাসায় উর্দু ভাষায় লেখা কেতাবাদি পড়ানো হয়। উর্দু ইসলাম ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় কোনো ভাষা নয়। আরবি হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় ভাষা। তাহলে মাদরাসাগুলোতে উর্দু ভাষার কেতাব পড়াতে হবে কেন? এ কঠিন ভাষাটি পরিহার করতে অসুবিধা কোথায়?
সরকারি ধারার মাদরাসা শিক্ষায় সিলেবাস ও কারিকুলামে এখনো অনেক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সিলেবাস ও কারিকুলামের এসব ঘাটতি দূর করতে হবে। সরকারি ধারার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে সরকার অনেক কিছু করে থাকে। বেসরকারি স্কুল-কলেজের ন্যায় মাদরাসায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এনটিআরসিএ'র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ চলমান আছে।
বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায় মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। অনেক মাদরাসায় শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ও বিনামুল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ন্যায় তারা ও উপবৃত্তির সুবিধা ভোগ করে থাকে। কিন্তু স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ন্যায় মাদরাসা শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ মনে হয় নেই।
স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মতো তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি আরো প্রসারিত করা দরকার। বিশেষ করে প্রশাসনিক পদগুলোতে শিক্ষাগত যোগ্যতায় বিএড কিংবা এমএড'র মতো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামুলক করা প্রয়োজন। এখন যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সেটি হচ্ছে মাদরাসার জেনারেল টিচারদের মধ্য থেকে সুপার, সহসুপার, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ইত্যাদি পদে নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির সুযোগ অবারিত ও উন্মুক্ত করতে হবে। যতটুক মনে হয় বর্তমানে এ সুযোগ তাদের একটুও নেই।
আজকাল প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। আইসিটি দক্ষতা বিশেষ করে বাতায়ন পরিচালনা ও কন্টেন্ট তৈরির নানা কলাকৌশল জানা থাকা অপরিহার্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, শিক্ষাবোর্ড ইত্যাদির ওয়েবসাইটের লেটেস্ট আপডেট কীভাবে জানা যায় সেটি ও জানা থাকতে হয়। মাদরাসার জেনারেল টিচারদের অনেকেরই সে দক্ষতা আছে।
আমাদের অনেকের ধারণা মাদরাসায় লেখাপড়া করে মসজিদের ইমাম কিংবা বড়জোর মাদরাসার শিক্ষক হওয়া যায়। সেটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। সে ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মাদরাসা শিক্ষাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে মাদরাসায় লেখাপড়া করে শিক্ষার্থীরা সমান তালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মত শিক্ষক, জজ, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট ইত্যাদি হতে পারে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে অংশ নিতে পারে। তারা যেন পুলিশের চাকরিতে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাদরাসার জেনারেল টিচাররা অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে পারেন।
মাদরাসায় দুই ক্যাটাগরির শিক্ষক রয়েছেন। এক ক্যাটাগরির শিক্ষকেরা মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। অন্য ক্যাটাগরির শিক্ষকরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। তারা মাদরাসায় জেনারেল টিচার হিসেবে পরিচিত। তাদের পেশাগত নানা সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব সমস্যার কারণে মাদরাসা শিক্ষা অনেক সময় গতি হারিয়ে বসতে পারে।
'বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার এসোসিয়েশন' নামে মাদরাসার জেনারেল শিক্ষকদের একটি সংগঠন আছে বলে জানি। অন্য আর কোনো নামে থাকলে জানা নেই। থাকলে থাকতেও পারে। প্রথমোক্ত সংগঠনটির কিছু কিছু কার্যক্রম চোখে পড়ে থাকে। সম্প্রতি তারা জেলায় জেলায় সম্মেলন করছেন। দু'দিন আগে চাঁদপুর জেলায় তাদের সম্মেলন শেষ হয়েছে। তাদের কথা মনযোগ সহকারে শুনে ব্যবস্থা নিলে জাতি লাভবান হবে।
আপাতদৃষ্টিতে সে সব তাদের নিজেদের স্বার্থ মনে হলেও নিছক তা নয়। শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থ অভিন্ন। এ সহজ কথাটি আমাদের কর্তা মশাইরা কেন বোঝেন না সেটি আমি বুঝতে পারি না। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষক শিক্ষার প্রাণ। মাদরাসা শিক্ষাকে অধিকতর আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার যে কোন উদ্যোগকে সবার সমর্থন করা উচিত। শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষকের যে কোন স্বার্থকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে জেনারেল টিচারদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় গুরুত্ব দেয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।