১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধরাধামে আবির্ভূত হবার বছর। আর মাত্র দু' মাস বাকি। আসছে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্মের শত বছর পূর্ণ হবে। যেদিন টুঙ্গিপাড়ায় মায়ের কোল আলোকিত করে মুজিব পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেদিন বাঙ্গালি জাতির সৌভাগ্যের তিলক হয়ে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। একজন মুজিবের কারণে জাতির ললাট থেকে পরাধীনতার হাজার বছরের কলঙ্ক তিলকটি মুছে গিয়েছিল। অন্ধকারে নিমজ্জিত এক জাতি খুঁজে পেয়েছিল আলোর সন্ধান। অজোপাড়াগাঁয়ের এক খোকা হয়ে উঠেন জাতির মহানায়ক। সমগ্র বাঙ্গালি জাতির পিতা। ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়া হয়ে উঠে জাতির আশা ভরসার শেষ ঠিকানা। সেখানে শেখ মুজিবের সমাধিতে আজও দুর্দিনের সাহস খুঁজে মানুষ। যে কয়জন মহামানব বিশ্ব ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন, মুজিব তাদের একজন। অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য ও শোষন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদী মানুষ শুধু আমাদের দেশে কেন, সারা দুনিয়ায় আর ক'জন জন্ম নেবে কে জানে? এ কারণে মুজিব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শেখ মুজিব স্বদেশকে স্বাধীন করার পর লক্ষ করেন, সারা পৃথিবী শোষকদের হাতে জর্জরিত ও ক্ষত-বিক্ষত। তাদের হাতে কুক্ষিগত মানব সভ্যতা। তাই জাতিসংঘে এক ভাষণে তেজদীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- "পৃথিবী আজ দুটো শিবিরে বিভক্ত। একদল শোষক আর একদল শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে"। সেদিন দুনিয়ার শোষক শ্রেণির টনক নড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে- মুজিব তাদের পক্ষের কোন মানুষ নন, প্রতিপক্ষের লোক। তারা অনুধাবন করে, মুজিবকে খতম করতে হবে। তা না হলে শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্যের পথ রূদ্ধ হয়ে যাবে। শোষণ ও বৈষম্যের পথ অবারিত রাখার জন্য শুরু হয় আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এর চূড়ান্ত ও শেষ পর্ব-১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাত। জাতির ইতিহাসে হাজার বছরের সবচেয়ে কলংকিত একটি অধ্যায়। পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মাথা হেট করে আমাদের সে কলংকটি বয়ে বেড়াতে হবে।
শেখ মুজিব হয়ত স্বপ্নেও ভাবেন নাই, তাঁর হাতে গড়া স্বদেশ তাঁর জন্মের শত বার্ষিকীতেও বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকবে। বিশেষ করে যে শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অতন্ত্র প্রহরী, সেই শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ সবচে' বেশী বৈষম্যের শিকার হবে। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় শিক্ষকেরা বৈষম্যের পাহাড়ের নীচে পাথরচাপা হয়ে বসবাস করবেন। জাতি যখন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, ঠিক তখন দেশের শিক্ষক সমাজের বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্যের যন্ত্রণা খোদ স্বাধীনতাকেই অর্থহীন করে তোলে। তথাপি ২০২০ সালে মুজিববর্ষ পালনের সিদ্ধান্তে দেশের শিক্ষক সমাজ শিক্ষা ও শিক্ষকের দূর্দিন ঘুচার প্রত্যক্ষ ঈঙ্গিত দেখতে পান। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক সম্প্রদায় মুজিববর্ষে তাদের প্রতি মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টি প্রত্যাশা করেন। তারা বিশ্বাস করেন, কেবল একজন শেখ হাসিনাই তাদের স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারেন। কেন জানি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের কাছে বাংলাদেশের মানুষের যেমন অফুরান প্রত্যাশা ছিল, তেমনি মুজিবকন্যা ও তাঁর সরকারের প্রতি সর্বসাধারণের প্রত্যাশার কোন শেষ নেই। বিশেষ করে শিক্ষক সমাজের।
শেখ মুজিব যেদিন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, বিধ্বস্ত অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ করেন, সেদিন থেকেই বেসরকারি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণের স্বপ্নের বীজ বপন হয়ে যায়। সঙ্গত কারণে ধারাবাহিকতায় এতদিনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সরকারিকরণ হয়ে যাবার কথা। এ কথা ঠিক যে, আমাদের শিক্ষায় কম উন্নতি হয়নি। ছনের ঘরের জায়গায় স্কুল-কলেজে দালান বিল্ডিং হয়েছে। বছরের প্রথম দিনেই ছেলেমেয়েরা নতুন বই হাতে পেয়ে যায়। নতুন পাঠ্য বইয়ের ঘ্রাণে ভরে যায় পুরো দেশ। এক সময় নতুন-পুরাতন মিলিয়ে পাঠ্য বই দেয়া হত। এখন সে অবস্থা নেই। আমাদের সময় বাজারে বই বের হতে হতে মার্চ পেরিয়ে যেত। বেশির ভাগ সময় উপরের শ্রেণির কারো কাছ থেকে অর্ধেক দামে পুরনো বই কিনে পড়তে হত। উপবৃত্তি চালু হবার কারণে এখন আর স্কুল বয়েসী কোন ছেলেমেয়ে বাড়িতে বসে থাকেনা। গাঁও গেরামের স্কুলেও এখন তিন ভাগের দু' ভাগ মেয়ে শিক্ষার্থী। দেখতে খুব ভাল লাগে। আমাদের সময় এক-আধজন মেয়ে মাত্র লেখাপড়া করত। শিক্ষায় আমরা স্বপ্নের অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে আসতে পেরেছি। তবু স্বপ্নের পূর্ণতা আজো মেলেনি। সেই স্বপ্নের ষোলকলা পূর্ণ হবার সময় এসেছে। মুজিববর্ষই সে উপযুক্ত সময়। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আসন চিরস্থায়ী করতে হলে মুজিববর্ষেই সব স্কুল-কলেজ একত্রে সরকারিকরণ করতে হবে। তা না হলে এত হাঁক ডাক করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপনের কোন অর্থ নেই।
১৯৭৫'র পর থেকে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত শুনে এসেছি-আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এলে সব স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হবে। বাবার মুখে শুনেছি। শিক্ষকদের কাছে শুনেছি। সাংবাদিকদের লেখায় পড়েছি। যারা এই কথাটি বলতেন তারা দৃঢ় আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই বলতেন। পঁচাত্তর পরবর্তী ১৯৯৬ তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার পর সেই স্বপ্নের কথাটি বার বার শুনে আসছি। যারা খুব আশাবাদী তাদের মুখে এবার হবে, আগামীতে হবে- করে করে আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা একটানা তিনবার সহ পাঁচবার ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। দেশে বেসরকারি স্কুল-কলেজে কর্মরত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী তাঁদের যৌবনের সোনালী দিনগুলোতে এই স্বপ্নটি দেখে শিক্ষকতার মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত হয়েছেন।
নতুন প্রজন্মের অনেকে এখন আর এ পথে আসতে চান না। অবাধ তথ্যের যুগে শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্যের চিহ্নগুলো আজ কারো অজানা নয়। গাঁও-গেরামের ছোট্ট রাখাল ছেলেটিও জানে বেসরকারি একজন শিক্ষক কত টাকা বেতন পান। তার বাড়ি ভাড়া কত। বোনাস কত পান। শিক্ষকের পরিবার জানে। জানেন আত্মীয় স্বজন। তাই অনেকের কাছে শিক্ষক আজও 'মাস্টার বেটা'। তুচ্ছার্থে সম্বোধন। কেবল কাগজে কলমে আর বই পুস্তকে শিক্ষকের মর্যাদার কোন শেষ নেই। আজকাল শিক্ষক হউন আর যেই হউন টাকা পয়সা না থাকলে কেউ কাউকে চার আনার দাম দেয়না। বলতে গেল এই জামানায় টাকাই সব। টাকা থাকলে মর্যাদার অভাব হয়না। কেবল টাকা পয়সা নয়, সুখে শান্তিতে জীবন যাপন আর মর্যাদা নিয়ে শিক্ষকদের বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্ষালে ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে সব স্কুল-কলেজ এক সাথে সরকারিকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। সেটি করা হলে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনের শুভ ক্ষণটি ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।