রাবির টর্চার সেলের নাম 'ভাইরুম' - দৈনিকশিক্ষা

রাবির টর্চার সেলের নাম 'ভাইরুম'

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি) আছে টর্চার সেল। তবে এখানে টর্চার সেলের নাম 'ভাইরুম'। প্রতিটি হলেই রয়েছে এমন 'ভাইরুম'। যেখানে বিভিন্ন সময় নানা প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের ডাকা হয়ে থাকে। শিবির সন্দেহে মারধর করে তাদের পুলিশে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। রাবিতে শিবিরের রগ কাটা রাজনীতির প্রভাব ছিল কয়েক দশক ধরে। ছাত্রলীগের প্রাধান্যের কারণে শিবিরের সেই রাজনীতির আপাতত অবসান হয়েছে। বুধবার (১৬ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সৌরভ হাবিব ও নুরুজ্জামান।

শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলেই রয়েছে ছাত্রলীগ ব্লক। ওই ব্লকের প্রতিটি কক্ষে শুধু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান করেন। ব্লকের সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ডাকা হয়। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ভাষায় ওই কক্ষটি ভাইয়ের রুম (ভাইরুম)। কাউকে শিবির সন্দেহ হলে বা বিভিন্ন প্রয়োজনে এসব রুমে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মারধরেরও অভিযোগ রয়েছে নানা সময়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগকে না জানিয়ে হলে ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলে সাজেদুল করিম নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসান মো. তারেক, ছাত্রলীগ কর্মী আল-আমিন ও হৃদয় সাহা। ওই শিক্ষার্থী বলেন, 'আমি বন্ধুর রুমে উঠেছিলাম। পরে আমাকে জুনিয়র ছেলেদের দিয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা ডেকে পাঠান। হলের সিট নিয়ে ঝামেলা চলছিল। যেতে দেরি হওয়ায় তারা আমাকে নানাভাবে হয়রানি করেন। বিষয়টি অন্যদের না জানাতে বলেন। আমি এক বড় ভাইকে জানালে ওই নেতা তার কক্ষে ধরে নিয়ে আমাকে মারধর করেন।'

অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে হাসান মো. তারেক বলেন, 'এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমার রাজনৈতিক ইমেজ নষ্ট করতে এসব অপবাদ দেওয়া হয়েছে।'

গত ৪ আগস্ট মতিহার হলের ২২৩ নম্বর কক্ষে আনিস নামে এক শিক্ষার্থীকে ডেকে পাঠান ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক তারেক আহমেদ খান। এ সময় তার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে তাকে মারধর করেন তারেক। গলায় ছুরিকাঘাতও করা হয়। এ ঘটনায় আনিস থানায় অভিযোগও দিয়েছেন।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর শহীদ শামসুজ্জোহা হলের অতিথিকক্ষে তারিক হাসান নামের এক শিক্ষার্থীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা গুফরান গাজীসহ কয়েকজন। সে সময় গুফরান গাজী ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। একই বছরের ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় ১৪ জন শিক্ষার্থীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২৩৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেখানে তাদের প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর করা হয়। তাদের চারজনকে পুলিশে দেওয়া হয়।

এর আগে ৪ জুলাই ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে 'কটূক্তি'র অভিযোগে এবং শিবির সন্দেহে গানের তালে তালে জসিম উদ্দীন বিজয় নামের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শহীদ মিনারের সামনে থেকে কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধু হলে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। শিবির সন্দেহে তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট রাত ১২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী হলের বিভিন্ন কক্ষে শিবিরবিরোধী অভিযান চালিয়ে ১২ শিক্ষার্থীকে মারধর করে ভোরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের পুলিশে দেয় ছাত্রলীগ।

২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট রাজশাহীতে বেড়াতে আসা জুন্নুন ওয়ালিদ বাবু নামে এক ভর্তিচ্ছুকে জিম্মি করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া, সহসম্পাদক মিজানুর রহমান সিনহা, ছাত্রলীগ কর্মী মাহফুজুর রহমান এহসান ও তৌশিক তাজ। ওই শিক্ষার্থীকে বঙ্গবন্ধু হলে নিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। ওই ঘটনায় এহসান ও তাজকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়। মিজানুর ও কিবরিয়াকে কেন্দ্রে বহিস্কারের সুপারিশ করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হলে কিবরিয়া হন রাবি শাখার সভাপতি। মিজানুর রহমান সিনহাসহ স্থায়ী বহিস্কৃত এহসান মাহফুজকে সহসভাপতি করা হয়।

এ বিষয়ে এহসান মাহফুজ বলেন, 'ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছিল। সেখানে মিজানুর রহমান সিনহা ও আমি উপস্থিত ছিলাম না। তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান রানা আমাকে অপছন্দ করতেন বলে ষড়যন্ত্র করে পরপর তিনবার বহিস্কার করেছিলেন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাতেও আমার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।'

এদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি- হলে কোনো টর্চার সেল বা ভাইরুম নেই। শিক্ষার্থীদের অযথা কোনো ধরনের হয়রানিও করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, 'হলে নানা রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। সেগুলো সভাপতি ও আমি সমাধান করে দিই। কোনো ব্যক্তির অপকর্মের জন্য গোটা ছাত্রলীগকে দায়ী করার মানে হয় না। যারা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একসময় শিবিরের আখড়া ছিল। শিবির ক্যাডাররা ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে ম্যানহোলে লাশ ফেলে দিয়েছিল। তারা তুহিন, তাকিম, টগরসহ অসংখ্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হাত-পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করেছে। ছাত্রলীগ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলেছে। এসব কারণে তারা সুযোগ পেলেই ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিয়ে মিথ্যাচার করে। এখানে ছাত্রলীগের কোন টর্চার সেল নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস রাখতে ছাত্রলীগ কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কারণ বিভিন্ন সময় শিবির ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টি করেছে। তাই কাউকে শিবির প্রমাণ পেলে তারা পুলিশের কাছে তুলে দেন।'

প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, রাবির হলে টর্চার সেল থাকার বিষয়টি গুজব। ছাত্রলীগকে হেয় করতে কেউ কেউ এমন গুজব ছড়াতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন এ বিষয়ে সজাগ আছে। তারপরও কোনো ধরনের তথ্য পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান চালাব।

নির্যাতন চলে রুয়েটেও : রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (রুয়েট) বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে হয়রানি-মারধরের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিজ সংগঠনের একপক্ষের হাতে অপরপক্ষের নেতারা মারধরের শিকার হয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট পূর্বশত্রুতার জেরে রুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-গণশিক্ষা সম্পাদক নির্ঝর আহমেদকে মারধর করেন দলীয় কর্মীরা। একই বছর ২৫ অক্টোবর সাইফ নামে এক শিক্ষার্থীকে 'শিবির' সন্দেহে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল হল থেকে আটক করে শহিদুল ইসলাম নামে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) এক ছাত্রকে মারধর করে পুলিশে দেয় ছাত্রলীগ।

এসব বিষয় অস্বীকার করে রুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রহমান নিবিড় বলেন, ছাত্রলীগ কাউকে মারধরের অনুমতি দেয় না। ছাত্রলীগের কেউ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

রুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ বলেন, 'এ ধরনের অভিযোগ পাইনি। বিভিন্ন সময়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। তেমন কোনো তথ্য পাইনি, পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।'

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0078871250152588