শক্তির উদ্বোধন - দৈনিকশিক্ষা

শক্তির উদ্বোধন

আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক |

একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে সাধারণজনের শক্তির উদ্বোধন আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করি গণজাগরণ মঞ্চে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখন একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চলছে এবং দু-একটা রায় বের হতে শুরু হয়েছে, তখন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই কিছু যুবক শাহবাগের মোড়ে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে শুরু করল অপরাধীদের ফাঁসির দাবি তুলে। দেখতে না দেখতে সে জমায়েত শাহবাগ ছাপিয়ে উপচে পড়ল, ছড়িয়ে গেল সারা বাংলাদেশে। তাদের সহায়তায় এগিয়ে এলেন অনেকে। কেউ পানি নিয়ে, কেউ খাবার নিয়ে এলেন, ফুল নিয়ে এলেন, তাদের অভিভাবকের বয়সীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ঢাকা ক্লাবের এক অরাজনৈতিক সদস্যকে দেখলাম, শ দুই প্যাকেট খাবার তুলছেন তাঁর গাড়িতে, নিজের হাতে সে খাবার গণজাগরণ মঞ্চে পৌঁছে দেবেন বলে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যে এবং দিল্লিতেও দেখলাম এ নিয়ে শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতূহল। তাঁদের অনুরোধে আমাকে এ বিষয়ে (তাঁদের ভাষায়, শাহবাগ আন্দোলন সম্পর্কে) বক্তৃতা করতে হলো, লিখতে হলো।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে আমার একটা দ্বিমত ছিল। গণ-আদালতের সময় থেকে আমি বলে আসছি, আমি বিচার চাই, কিন্তু শাস্তির ব্যবস্থাপত্র দিতে পারি না। যাঁদের কাছে বিচার চাই, তাঁরাই সবকিছু পর্যালোচনা করে শাস্তি নির্ধারণ করবেন। শাস্তি কী হবে, তা নিরূপণ করে দিলে বিচারকেরা কি কেবল আমার দাবির পক্ষে রায় দিতে বসবেন?

এ সত্ত্বেও গণজাগরণ মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তাদের সঙ্গে আমার সংহতি প্রকাশ করেছি। আমার মনে বাধাটা কোথায়, তা ব্যাখ্যা করেও তাদের সমর্থন জানিয়েছি। কারণ, এই অসংগঠিত শক্তির বিস্ফোরণ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, আশান্বিত হয়েছি, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি।

চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন ঘটে গেল সেদিন, তার মধ্যেও ঘটেছে অসংগঠিত শক্তির উত্থান। আন্দোলনকারীরা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তারা অল্পসংখ্যক থেকে অধিকসংখ্যকে পরিণত হয়েছে। তাদের দাবির ন্যায্যতা প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন।

আন্দোলনকারীদের অন্তত একজন যে ‘আমি রাজাকার’ লেখা টি-শার্ট পরে এতে যোগ দিয়েছিল, মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা থেকে সে কথা জেনে আমি মর্মাহত হয়েছি। এই আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চলে, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই তার নিন্দা করবেন। কিন্তু তা ছিল এই আন্দোলনের বিকার, এর স্বরূপ নয়। জাতীয় সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পর আবার আন্দোলনে প্রবৃত্ত হওয়াও এদের ঠিক হয়নি। তাতেও কিন্তু মূল আন্দোলনের ন্যায্যতা ক্ষুণ্ন হয় না। রাষ্ট্রীয় একটা ব্যবস্থা যদি অযৌক্তিক হয়, তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সত্য ও ন্যায়ের পরিপোষকমাত্র।

অসংগঠিত শক্তির উত্থান আবার প্রত্যক্ষ করলাম গত কয়েক দিনে। এবার আন্দোলনকারীরা বয়সে আরও ছোট। সদ্য হওয়া যুবক, কিশোর, এমনকি শিশুও এককাতারে এসে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া বাসচালকের পরিণামচিন্তাহীন বাসচালনায় সহপাঠী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে। তারা শোক করেছে, আপত্তি জানিয়েছে, দাবি তুলেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের আন্দোলনের তৃতীয় দিন থেকে তারা রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলায় শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছে। বেআইনি চালকদের পুলিশে সোপর্দ করেছে, অনুমতিহীন গাড়ি আটকে রেখেছে। তারা একটি বা দুটি স্কুলের ছাত্র নয়, ঢাকার বহুসংখ্যক স্কুল-কলেজের বহুতর ছাত্রছাত্রীরা একযোগে পথে নেমেছে, দাবিনামা প্রণয়ন করে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে।

আন্দোলনের প্রথম দিনে সড়ক অবরোধের কালে আমিও পথে কয়েক ঘণ্টা আটকে থেকে কষ্ট পেয়েছি। আমি জানি, অনেক বিমানযাত্রী ফ্লাইট ধরতে পারেননি। রোগীকে নিয়ে অনেকে হাসপাতালে পৌঁছাতে অপারগ হয়েছে, অনেক বয়স্ক মানুষকে কষ্ট সহ্য করে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। তারপরও এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আমি শুধু সবিস্ময়ে অবলোকন করিনি, সন্তুষ্ট চিত্তে প্রণতি জানিয়েছি।

এই তিন ক্ষেত্রেই অভিন্ন আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার কিছুসংখ্যক যুবক গণজাগরণ মঞ্চ আক্রমণ করে তা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, কিন্তু এই আন্দোলন দুর্বল হয়েছে। হয়তো এই মঞ্চ এখন তার প্রয়োজন হারিয়ে ফেলেছে। তবে যেভাবে তা আক্রান্ত হয়েছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি এবং এদের অবশিষ্টাংশকেও সরকারবিরোধী করে তোলা হয়েছে।

কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীরাও সেই পক্ষের দ্বারাই নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এবং এ দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিমত প্রকাশের অধিকার কি বিসর্জিত হলো?

সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলনকারীরাও কি এই পরিণতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে? যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ছাত্রদের দাবি যৌক্তিক, সেখানে কোনো ছলে তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগও একটা প্রতিবাদযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

যাঁরা বলছেন, সড়কপথে নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব ছাত্রদের নয়, তাঁদের কথা স্বীকার করেও বলব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের ব্যর্থতায় বা প্রশ্রয়ে সড়কপথে কী নৈরাজ্য চলছে, ছাত্ররা এক দিনে তা দেখিয়ে দিল। এরপরও কি আমাদের চোখ খুলবে না?

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত যত আন্দোলন ঘটেছে, ক্ষমতাসীনেরা তাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে চিহ্নিত করেছে। ষাটের দশকে এনএসএফ সংগঠনের সদস্যেরা বিরোধীপক্ষীয় ছাত্রদের উৎপীড়ন করেছিল। পরিণাম কী হয়েছে, তা আমরা সবাই জানি।

বিরোধীদলীয় রাজনীতিকেরা যে ছাত্র আন্দোলন বা গণ-আন্দোলনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন, তা স্বাভাবিক। আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি না থাকলে এবং কালক্ষেপণ করলে তাঁরা সে সুযোগ পাবেন।

কাগজে দেখলাম, এক মা আন্দোলনকারী ছাত্রদের জন্য বৃহস্পতিবার খাবার নিয়ে গেছেন। আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনার গড়ে উঠলে আব্বাকে নিয়ে মা সেখানে গিয়েছিল এবং তার কাছে রাখা আমার এক মৃত বোনের সোনার হার নিবেদন করে এসেছিল। এই মায়েরা অন্তর দিয়ে যা উপলব্ধি করে, তা ধরার ধুলায় হারিয়ে যায় না। উদ্বোধিত শক্তি নিজের পথ করে গন্তব্য খুঁজে নেয়।

 

সূত্র: প্রথম আলো

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.028709173202515