আমার এক বন্ধুর কাছে ঘটনাটা শুনেছি। প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। একমাত্র মেয়ে ঢাকার একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। হঠাৎ একদিন তাঁকে আর তাঁর স্ত্রীকে স্কুলে তলব করা হলো। ঘটনা কী? ঘটনা হলো, বন্ধুর মেয়ের চলাফেরা ভালো নয়। চলাফেরা বলতে বোঝানো হলো, মেয়েটির ক্লাসের বেঞ্চিতে বসা ভালো না। হাঁটাচলা ভালো না। শরীরের কাপড় ‘ঠিকঠাক’ করে রাখতে পারে না।
তাকে দেখে স্কুলের অন্য মেয়েরা নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বন্ধু ও বন্ধুপত্নীকে ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল ‘যাচ্ছেতাই ভাষায়’ নানা কথা বলে চলেছেন, আপনাদের সমস্যা কী বলেন তো! মেয়েকে আদবকায়দা কিছুই শেখাননি? তার তো চলাফেরা ভালো না। শরীরের কাপড় ঠিক রাখতে পারে না। এভাবে চললে আমরা কিন্তু তাকে আর স্কুলে রাখতে পারব না...মেয়ের সামনে মা-বাবাকে অপমান করা হচ্ছে। মা-বাবা বিনীত ভঙ্গিতে প্রিন্সিপালের কাছে তাঁদের ভুল স্বীকার করে যাচ্ছিলেন। বাবা বলছিলেন, ‘ম্যাডাম, আমাদের ভুলটা ঠিক কোথায় বুঝে উঠতে পারছি না। তবু আপনি যখন বলছেন তখন আমরা মেয়ের ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হব। আশা করি, ভবিষ্যতে আর কোনো অভিযোগ করার জন্য আপনি আমাদের ডাকবেন না।’
প্রিন্সিপালের রুমে বন্ধু আর বন্ধুপত্নী তাঁদের একমাত্র আদুরে মেয়ের সামনে প্রিন্সিপালের কটু কথায় যারপরনাই অপমানিত বোধ করছিলেন। রুমের দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে স্কুলের অনেক ছাত্রী, এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকাও ঘটনা দেখছিলেন। ভাবটা এমন—প্রিন্সিপালের রুমে মারাত্মক তিনজন অপরাধীকে হাজির করা হয়েছে। প্রিন্সিপাল তাদের জেরা করছেন। এটাকে এক ধরনের ‘তামাশা’ ভেবে তামাশা দেখার জন্যও অনেকে ভিড় করেছে।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বন্ধুর মেয়েটি ওই যে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, আর তো দরজা খোলে না। বন্ধুর স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। মায়ের কান্না শুনে মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে মা-বাবা দুজনকেই বলল, ‘আমি ওই স্কুলে আর পড়ব না। তোমরা আমার জন্য অন্য স্কুল দেখো!’ বলা বাহুল্য, মেয়েটিকে পরের বছর অন্য স্কুলে ভর্তি করা হলো। সে এখন দেশের বাইরে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
ভাগ্য ভালো বন্ধুর মেয়েটি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর মতো ভুল করেনি। অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে ঢুকেছিল অরিত্রী এবং মোবাইল ফোনে প্রশ্নের উত্তর দেখে দেখে পরীক্ষার খাতায় লিখেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে অরিত্রী অপরাধ করেছে। এ জন্য অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শাস্তির ধরনটা কেমন হবে? অরিত্রীর মা-বাবাকে ডেকেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রচারমাধ্যমের খবর অনুযায়ী জানা যায়, অপরাধের ক্ষমা চেয়ে মা-বাবার সামনে স্কুল প্রিন্সিপালের পা জড়িয়ে ধরেছিল অরিত্রী। কিন্তু সে ক্ষমা পায়নি। অরিত্রীর মা-বাবা কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রীর হয়ে প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা করেননি স্কুলের প্রিন্সিপাল ও পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনরত শিক্ষিকা। প্রিন্সিপাল অরিত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
অথচ দুটি ঘটনারই চিত্র অন্য রকম হতে পারত। শুধু কি পরীক্ষায় পাস করার জন্যই মা-বাবারা তাঁদের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠান? ঠিক তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষাদানের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনেরও আদর্শ স্থান। প্রশ্ন তো তোলাই যায়, এই যে অরিত্রী মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকল, কিভাবে ঢুকল? পরীক্ষার হলে তার তো মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকার কথা নয়। কে তাকে এই সুযোগ দিল? পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় পরীক্ষার্থী পরীক্ষাবহির্ভূত কোনো কিছু নিয়ে হলে ঢুকছে কি না সে ব্যাপারে তো নজরদারি থাকার কথা। ধরা যাক, অরিত্রী সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো ধারণা করাই যায় পরীক্ষার হল প্রকৃতপক্ষে নজরদারিতে ছিল না। অরিত্রীর মতো হয়তো আরো অনেকে পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকেছিল। অরিত্রী ধরা পড়েছে, অন্যরা ধরা পড়েনি। এখন কথা হলো, অরিত্রী যেহেতু ধরা পড়েছে, কাজেই তার বিচার হওয়া জরুরি। কিন্তু বিচার মানেই কি স্কুল থেকে বহিষ্কার? অরিত্রীর বয়সী ছেলে-মেয়েরা খুব সহজে ভুল করে, অতি সহজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। কাজেই তাদের সুপথে পরিচালনা করা যেমন পরিবারের দায়িত্ব, তেমনি স্কুল কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব রয়েছে। অরিত্রী তার ভুলের জন্য প্রিন্সিপালের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল। শুধু অরিত্রী নয়, তার মা-বাবাও করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছেন। অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা করেনি। প্রশ্ন তো তোলাই যায়, অরিত্রী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরীক্ষায় নকল করেছে। এই সাহস সে পেল কিভাবে? তর্কের খাতিরে যদি বলি, এ জন্য অরিত্রীর অভিভাবকই দায়ী। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন তো এসেই যায়, এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষও কি দায়ভার এড়াতে পারে?
অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রিন্সিপালসহ অভিযুক্ত তিন শিক্ষিকাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একজন শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
বিশিষ্ট চিকিৎসক, মনোবিদ মোহিত কামাল লিখেছেন, আত্মহত্যা কখনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। তাঁর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী কাওসার সুইট লিখেছেন, যে ছাত্রী আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নিল সে নিশ্চয়ই কোনো তুচ্ছ কারণে এমনটা করেনি। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, শিক্ষকের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল সে। তবু কেন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো না। কেন তার মা-বাবাকে অপমান করা হলো? পাল্টা উত্তরে মোহিত কামাল লিখেছেন, এসব প্রশ্ন তোলা জরুরি। তবে কোনোমতেই আত্মহত্যা নয়। দিলু মজুমদার লিখেছেন, এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা একটু অভিমানী হয়। ভুল তারাই করে। সে কারণে স্কুলের শিক্ষকরা তাদের ভুল ধরিয়ে দেবেন, শাসন করবেন—এটাই নিয়ম। তবে ভুলের কি ক্ষমা নেই? এর জন্য অভিভাবককে অপমান করতে হবে? কথায় আছে, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে! দেশের কয়জন শিক্ষকের বেলায় এই কথা প্রযোজ্য!
অরিত্রী আত্মহত্যা করার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রতিবাদের ঝড় থামাতে এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তাঁর উপস্থিতিতে এক দল অভিভাবক স্কুলটির অনেক অনিয়ম নিয়ে কথা বলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এ ঘটনার ভিডিও চিত্রে দেখা গেল, শিক্ষামন্ত্রীর পাশে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন স্কুলের প্রিন্সিপাল। একজন অভিভাবক শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘স্যার, আমি একটা কথা বলব। স্কুলের নানা রকম সমস্যা নিয়ে আমরা কয়েকজন অভিভাবক একটা লিখিত অভিযোগ চেয়ারম্যান বরাবরে দিয়েছি। কিন্তু এই চিঠিটা কে তাঁর কাছে পৌঁছাবেন তার সাহস পান না। প্রিন্সিপালকে আমরা চিঠিটা দিয়েছি। অনুরোধ করেছি আপনি কমিটির অন্যদের কাছে চিঠির কপি পৌঁছে দেবেন। কিন্তু প্রিন্সিপাল আমাদের সহযোগিতা করেননি।’ সঙ্গে সঙ্গেই আরেকজন মহিলা অভিভাবক শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘স্যার, আমি ছোট একটা ঘটনা বলি। হয়তো বলতে পারেন এটা তো এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তবু বলি। এই স্কুলে আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তাকে স্কুলের একজন শিক্ষক ডেকে নিয়ে হুমকি দেন, তোমার জীবন আমি শেষ করে দেব...বাসায় গিয়ে আমার মেয়ের নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যায়। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। অনেক কষ্ট করে আমি তাকে পিএসসি পরীক্ষা দেওয়াই...অরিত্রীর ঘটনার পর মেয়ে আমাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তুমি যদি আমাকে ওই স্কুলে পাঠাও, তাহলে আমিও সুইসাইড করব...।’
দেশের একটি নামকরা স্কুলের বিরুদ্ধে এভাবেই অভিযোগ শুনলেন শিক্ষামন্ত্রী। ভিডিওটি দেখে আমি যারপরনাই শঙ্কিত। এই যদি হয় নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র, তাহলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ কী?
শেষে আমার বাবার কথা বলি। তিনি একজন প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি ‘খেলার স্যার’ নামে পরিচিত ছিলেন। অঙ্ক আর ইংরেজি পড়াতেন। একদিন পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রকে বেদম প্রহার করেন। ঘটনা কী? ঘটনা হলো, ওই ছাত্র ক্লাসের সাপ্তাহিক অঙ্ক পরীক্ষায় নকল করেছে। বাবা স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছেন। তাঁকে অন্যমনস্ক দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ বাবা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার ছাত্র পরীক্ষায় নকল করে। আমি তাহলে তাকে কী শেখালাম! ছেলেটাকে খুব মেরেছি। সে জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!’ রাতেই ছেলেটির বাসায় ছুটে যান বাবা। ছাত্রকে অভয় দিয়ে আদর করে বলেন, ‘চিন্তা করিস না, আজ থেকে আমি তোকে স্কুলের ক্লাসের বাইরেও অঙ্ক শেখাব!’
এই গল্প যখন কোথাও বলি তখন অনেকেই আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। ভাবটা এমন, আমি বাড়িয়ে বলছি। আবার অনেকে মন্তব্য করেন—ভাই, এখন আর এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষককে পাবেন না। শিক্ষা তো এখন শিক্ষার মধ্যে নেই। ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সত্যি কি তাই? প্রিয় পাঠক, আপনারা কী বলেন?
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক, আনন্দ আলো
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ