সন্তানের কাছে পিতা হলেন সুপার হিরো। যদি কখনো নিজের কোনো অপরাধে সুপার হিরো অপমানিত হন, তবে সেই অপমান শত-সহস্র গুণ ভারী হয়ে গলার ফাঁসে পরিণত হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। তার আত্মহত্যার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ মিডিয়াতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
অরিত্রী একজন শিশু। শিশুরা ভুল করতেই পারে, কিন্তু সেই ভুল কি অমার্জনীয়? বিদ্যালয়ে এমন নির্মম আচরণবিধি কিভাবে তৈরি হলো? শিক্ষকরা কি অমানুষে পরিণত হয়েছেন? প্রতিটি ধর্মেই বলা হয়েছে ক্ষমা মহত্ত্ব্বের লক্ষণ। শিক্ষকদের মধ্যে মহত্ত্ব কি লোপ পেয়েছে?
শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা জেনে-বুঝেই শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসা উচিত। অন্যদিকে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা শিক্ষক ক্লাস কার্যক্রমে অনুশীলনের পাশাপাশি সুকৌশলে শেখাবেন। তবে শিক্ষকদের মধ্যে তেমন গুণ থাকতে হবে। কাউকে হেয় করার জন্য বলছি না—বাংলাদেশে অনেক শিক্ষক আছেন যাঁদের মধ্যে শিক্ষকতার মহান গুণাবলির কমতি রয়েছে। অনেকেই মনে করেন মেধাবী ও সুন্দর মানসিক চিন্তা ও রুচির মানুষেরা এ পেশায় আসছেন না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবন থেকেই স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হওয়ার। অথচ আমার দেশের শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। আর চাকরি না পেলে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিতে বাধ্য হয় শিক্ষিত বেকাররা! দ্বারে দ্বারে ঘুরে চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতাকে যে বেছে নিল জীবিকা হিসেবে, তার কাছ থেকে বকাঝকা আর অপমান ছাড়া আমরা কী আশা করতে পারি? তবে অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা শিক্ষার্থীকে উজাড় করে দিতে চান, শেখাতে চান। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি তাঁদের প্রতিকূলে।
‘শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে যেন তারা কোনোভাবেই কোনোরকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার না হয়। শিশুদের স্বাভাবিক অনুসন্ধিত্সা ও কৌতূহলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ও উচ্ছ্বাসকে ব্যবহার করে আনন্দময় পরিবেশে মমতা ও ভালোবাসার সঙ্গে শিক্ষা প্রদান করা হবে।’ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এমন নির্দেশনা থাকলেও কিছুদিন পরপরই শিক্ষার্থী প্রহার, যৌন হয়রানি, অতিরিক্ত ফি আদায়, ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় সামনে আসছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারীর বক্তব্য অনুযায়ী, স্কুলে মোবাইল নেওয়া নিষেধ হলেও অরিত্রী গত রবিবার মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে যায়। দায়িত্বরত শিক্ষকরা মোবাইল ফোনটি জব্দ করেন, চেক করেন, অরিত্রীর মোবাইলে নকল পাওয়ায় অরিত্রীকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেন। সোমবার সকালে পরীক্ষা দিতে স্কুলে গেলে অরিত্রীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে তার বাবা-মাকে ডেকে পাঠান স্কুল কর্তৃপক্ষ। অরিত্রীর বাবা-মা স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে নকল করার কথা স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ভাইস প্রিন্সিপাল নিরুপায় হয়ে প্রিন্সিপালের কক্ষে পাঠিয়ে দেন। সেখানে অরিত্রীর ভুলের জন্য ক্ষমা চান তার বাবা-মা। কিন্তু প্রিন্সিপাল সদয় না হয়ে অরিত্রীকে টিসি (ছাড়পত্র) দেওয়ার নির্দেশ দেন।
অরিত্রী অধিকারী অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চলে গেল না-ফেরার দেশে। কিন্তু যে ক্ষত মনের মাঝে সৃষ্টি করে গেল, তার উপশম একমাত্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীই দিতে পারেন। দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যেন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ সকল শিক্ষক উপলব্ধি করেন—শারীরিক ও মানসিক শাস্তির পরিবর্তে মটিভেশন জরুরি।
ঢাকা