শিক্ষক বিদ্যাসাগর এবং আমরা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক বিদ্যাসাগর এবং আমরা

গোলাম কবির |

বিদ্যাসাগর ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’ ধারণ করেছিলেন বলে এযাবৎকালের মধ্যে তাঁর মতো অসামান্য মহান শিক্ষক বাংলার মাটিকে ধন্য করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যত বড় খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন, ততোধিক ছিলেন ‘যথার্থ মানুষ’। বিদ্যাসাগরের মনুষ্যত্বের পরিচয় উপস্থাপন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সোয়া শ বছর আগে (১৩ শ্রাবণ, ১৩০২) বলেছিলেন : ‘তিনি যে বাঙালি বড়লোক (ধনাঢ্য) ছিলেন, তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’ (বিদ্যাসাগর চরিত্র) কবি রবীন্দ্রনাথ পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন বলে পরবর্তী সময় বলতে পেরেছিলেন, মনুষ্যত্বের শিক্ষাই বড় শিক্ষা।

বিদ্যাসাগর ছিলেন দরিদ্রের সন্তান; কিন্তু সে দরিদ্রতা মননের নয়, বিষয়-সম্পত্তির। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং জননী ভগবতী দেবীর অফুরন্ত হৃদয় বাৎসল্য বিদ্যাসাগরের চরিত্রকে এক অনন্য পৌরুষে রূপান্তরিত করেছিল। তাই তিনি প্রাচীন মুনি-ঋষিদের মতো প্রজ্ঞাবান এবং বাঙালি মায়ের মতো স্নেহসিক্ত হৃদয় লাভ করেছিলেন।

শিক্ষক বিদ্যাসাগর সতত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, শিক্ষকদের দলবাজি কিংবা লেজুড়বৃত্তির ধারেকাছে থাকা কাম্য নয়। তিনি তা করেননি। প্রবল পরাক্রান্ত বেনিয়া শাসকের অমর্যাদাকর নির্দেশে তিনি চালিত হননি। দেননি ব্যক্তিত্বের বিসর্জন। আজকের দিনের তুলনায় অনেক গুণ বেশি টাকা বেতনের অধ্যক্ষের চাকরি তিনি পরম অবহেলায় অম্লানচিত্তে পরিত্যাগ করেছেন। সে সময়ে তাঁর গৃহে প্রায় চার গণ্ডা আশ্রিত ছিল। এমন কোনো সঞ্চয় ছিল না, যা দিয়ে তাদের গ্রাসাচ্ছাদন চালাতে পারেন। তবুও তিনি তাঁর সংকল্প থেকে সরে যাননি।

শিক্ষক হবেন সর্বোচ্চ মেধাবী। বিদ্যাসাগর সমকালে অতুল মেধার অধিকারী ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ তাঁর অনমনীয় ছাত্রটির মেধার খবর জানতেন। তাই নিচের শ্রেণির শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও ‘সত্যকথনের মহিমা’ শীর্ষক একটি রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে তাঁকে নির্দেশ দেন। রচনা লিখে প্রথম স্থান অধিকার করে সংশ্লিষ্টদের বিস্মিত করেন কিশোর ঈশ্বরচন্দ্র।

বিদ্যাসাগরের যাপিত জীবন ছিল অনাড়ম্বর। আক্ষরিক অর্থে তিনি মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় পরিধান করতেন। বিদেশি ফ্যাশনের হুজুগে আত্মাহুতি দেননি তিনি। ‘দয়ার সাগর’ বিদ্যাসাগর মাছ-মাংস-দুধ বর্জন করে জীবে দয়ার ধর্ম আত্মস্থ করে মনুষ্যত্বকে অক্ষয় রেখে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনাচরণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তবে শিক্ষা ও শিক্ষকতায় আর পাঁচজন গড় শিক্ষক থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সংস্কৃত ভাষা শেখার জটিলতা নিরসনের জন্য তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা রচনা করে প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডারকে রাজপ্রাসাদের প্রকোষ্ঠ থেকে সাধারণ্যের জন্য বোধগম্য করার পথ বাতলিয়ে দিয়েছিলেন। এতে প্রথমে তাঁর শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ ক্ষুব্ধ হলেও পরে অসাধারণ বিদ্যাসাগরকে আশীর্বাদ করেন।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষা বাংলার প্রাধান্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন বিদ্যাসাগর। কখনো লোভের বশবর্তী হননি। কর্তৃপক্ষের অমূলক প্রস্তাব তিনি শিক্ষকসুলভ দৃঢ়তায় প্রত্যাখ্যান করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে পারিপার্শ্বিকের কৃতঘ্নতায় ব্যথিত হয়ে বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াত শিশু পৌত্রী প্রভাবতী স্মরণে যে শোকগদ্য রচনা করেন, সেখানে দুঃখের সঙ্গে উচ্চারণ করেন : ‘বোধ হয় যদি এই নৃশংস নরলোকে অধিক দিন থাক, উত্তরকালে অশেষ যন্ত্রণাভোগ অপরিহার্য, ইহা নিশ্চিত বুঝিতে পারিয়াছিলে।’ রবীন্দ্রনাথও জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে বলেছিলেন : ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ।’

১৯৮ বছর আগে এই দিনে (২৬ সেপ্টেম্বর) বিদ্যাসাগর যেসব ব্রত নিয়ে—‘প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ ‘ধরায়’ এসেছিলেন, তার কিঞ্চিৎ আমরা অনুসরণ করলে শিক্ষার সর্বস্তরে সততা ও প্রজ্ঞার সুবাতাস প্রবাহিত হতো। অধিকতর আলোকময় হতাম আমরা।

আজকের দিনের বেশির ভাগ সনদধারী ব্যক্তি রাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মসংস্থানে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষকতায় আসেন। ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে তা অণুবীক্ষণীয়। যেমন— আমার এক আত্মীয়। তার কথা না-ই বা বললাম। আবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে গেছেন তার উদাহরণ কম নেই। যাঁরা অনেকটা বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডিতে আবদ্ধ আছেন, তাঁদের অনেকে জ্ঞানের তরক্কির জন্য নয়, ছিটেফোঁটা সম্পদের তলানির জন্য। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একই পথের পথিক হয়েও দল-উপদলে বিভক্ত কেন? এখানে এখন শিক্ষক নামের পরিচয়ে নানা কিসিমের মক্করবাজ। কেউ চেতনাবাদী, কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ সাম্যবাদী, কেউ আবার ধর্মবাদী। তাঁদের সবার লক্ষ্য জ্ঞানদান করে আত্মপ্রসাদ লাভ নয়, আর্থ-প্রসার ঘটিয়ে সাফল্যের ঢেকুর তোলা। এখানেই শেষ নয়। একই মতবাদের শিক্ষক ত্রিধাবিভক্ত। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কোন মেসেজ পাবে! আর জনগণের চেতনায় শিক্ষক সম্পর্কে কী ধারণা জন্মাবে?

বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে আমরা অতীতের পানে চেয়ে দেখতে পাব, জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি নিয়মিত আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য বাদুড় বাগানে যে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, সেখানে না থেকে শহর থেকে দূরে কর্মটাড় স্টেশনের কাছে সাঁওতালপল্লীতে বসবাস করে কিছুটা প্রশান্তি অনুভব করেছেন।

সব শিক্ষককে বিদ্যাসাগরের মতো হতে হবে আমরা তা বলছি না, তবে শিক্ষক বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কিয়দংশ সব শিক্ষক অনুসরণ করলে আমাদের মজ্জমান শিক্ষাব্যবস্থা কূলের সান্নিধ্যে ফিরতে পারত, সেই আশাবাদ বোধ করি ব্যক্ত করা যায়।

 

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038609504699707