শিক্ষাবণিক বনাম শিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষাবণিক বনাম শিক্ষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আসুন আমাদের প্রচার মাইক লক্ষ্য করে, দেখুন আমাদের জিনিষগুলো। মাত্র ২০ টাকা, ২০ টাকা এবং ২০ টাকা। এইরকম স্লোগান বা বিজ্ঞাপন রাস্তার ফুটপাতের হকারের থেকে শোনা গেলেও এমন আহ্বান এখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শোনা যায়। সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে দেশব্যাপী চলছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষকদের সান্ধ্যকালীন কোর্সে বাড়তি মনোযোগ দেশের সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে। মঙ্গলবার (৩০ মে) দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন মো. আখতার হোসেন আজাদ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সান্ধ্যকালীন কোর্সের সংখ্যা। এসব কোর্সে যেসব শিক্ষক পড়ান, তাদের জন্য বাড়তি অর্থ কামানোর সুযোগ এটি। এছাড়াও টাকার টানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছুটছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আবার নিচ্ছেন সরকারি বেতন-ভাতাও।

কাঁচা টাকার গন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স-শিক্ষকেরা নিয়মিত শ্রেণীকক্ষে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকলেও সান্ধ্য কোর্সে পাঠদানে ঠিক সময় উপস্থিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছেন। শিক্ষার্থীদের কঠোর প্রতিবাদের পরেও থামছে না এ সুবিশাল শিক্ষা বাণিজ্য। সান্ধ্যকালীন এই শিক্ষাবাণিজ্যের ফলে মূল শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে যার ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের উদাসীনতায় সেশনজটের কবলে পড়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, নষ্ট হচ্ছে সম্ভাবনাময় জীবন। নিয়মিত পাঠ না পেয়ে অনেকে অসম্পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে উচ্চশিক্ষার সনদ অর্জনে বাধ্য হচ্ছেন। সান্ধ্যকালীন প্রসঙ্গ আসলে শিক্ষার দোকানদারের ভূমিকা পালন করেন আর ভুলে যান সব নীতিবাক্য। বিশ্ববিদ্যালয় কোন অবস্থাতেই বাণিজ্য কেন্দ্র নয় এটি যেন তখন তাদের স্মরণেই থাকে না।

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রয়েছে। নামে-বেনামে অসংখ্য সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তর শ্রেণী খোলা, ভর্তি ছাড়া নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তির খবর পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই প্রকাশ হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৬ সালের পর থেকে চালু হওয়া সান্ধ্যকোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও এর মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠছে। অর্থের বিনিময়ে স্বল্প সময়ে ও তুলনামূলক কম পড়াশোনা করে পাওয়া এই সনদ কতটা মানসম্পন্ন তা নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদদের মাঝে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে ২০০৬ সালে। ওই কৌশলপত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করা হয়। সান্ধ্যকোর্সের নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকরাই এই কোর্স পরিচালনা করেন। সিলেবাস তৈরি, পাঠদান, প্রশ্নপত্র তৈরি, উত্তরপত্র নিরীক্ষাসহ পরীক্ষার ফলও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই প্রস্তুত করেন। আবার কখনও কখনও নিজ কোর্সে পরীক্ষার হলে নকল করতে সাহায্য করার খবরও পত্রিকায় প্রকাশ হতে দেখা যায়।

টাকা থাকলে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি এবং ভালো (!) সিজিপিএ পেতে শিক্ষার্থীদের বেশি বেগ পেতে হয় না। ফলে সান্ধ্যকোর্সের শিক্ষার্থীরাও বলতে দ্বিধা করেন না সান্ধ্যকোর্সের মান ক্রমান্বয়ে নিম্ন থেকে নিম্নতর হচ্ছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীরা কঠোর পরিশ্রম করে হাজার হাজার দেশসেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভর্তিপরীক্ষা নামক যুদ্ধে বিজয়ী হয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু সান্ধ্যকালীন কোর্সের ক্ষেত্রে যেন ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ নীতি প্রযোজ্য। সান্ধ্যকালীন কোর্সে নামমাত্র ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। কখনও আবার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও কিংবা কোর্স চলাকালীন মাঝপথে এসেও ভর্তি হওয়া যায়।

যেহেতু সান্ধ্যকালীন কোর্স খোলার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো টাকার বিনিময়ে উচ্চ শিক্ষা। তাই শিক্ষকরা শিক্ষার মান মান নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন। আবার কখনও কখনও এই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ, দলাদলির খবরও পত্রিকার পাতায় শোভা পায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (ইউজিসি) অধ্যাপক আবদুল মান্নান স্যারকে বরাবরই সান্ধ্যকালীন কোর্স প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্নের উত্তর প্রদানে কৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা যায়।

গত কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন নিয়মিত হোক আর সান্ধ্যকালীন হোক, শিক্ষার মান অবশ্যই ঠিক রাখতে হবে। নিয়মিত ও সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থীদের একই প্রক্রিয়ায় ভর্তি করাতে হবে, ক্লাস নিতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট থাকার পরেও শিক্ষকদের এই সান্ধ্যকালীন কোর্সের রমরমা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সোচ্চার হতে দেখা যায়। কিন্তু অর্থের কাছে যেন শিক্ষকদের নৈতিকতা উবে যায়। শিক্ষার্থীদের দাবিকে গুরুত্বই দিতে দেখা যায় না।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বাম্পার ফলন শুরু হয়েছে, তাতে যে সব আশঙ্কা করা হচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য হলো-

শিক্ষকদের মানসিকতা বদলে যাবে। কারণ সান্ধ্যকালীন কোর্স যারা করতে আসবেন, তাদের অধিকাংশের মূল উদ্দেশ্য সনদপত্র সংগ্রহ। তাই যতই টাকা লাগুক না কেন, তারা সান্ধ্যকোর্সে ভর্তি হবেন। ফলে এই কোর্স করার জন্য শিক্ষার্থীর অভাব হবে না। আর এই কোর্সের অধীন যে টাকা পাবেন, নিয়মিত ক্লাস বাবদ পাবেন তার থেকে কয়েকগুণ কম। যার ফলে নিয়মিত ক্লাসের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হবে। অনেক শিক্ষক যুক্তি দেন, সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার সম্প্রসারণ। কিন্তু উনারা হয়ত অর্থের মোহে ভুলে যান ভর্তিযুদ্ধ অতিক্রম করে আসা একজন শিক্ষার্থী আর টাকার বিনিময়ে নামমাত্র ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসা শিক্ষার্থীর মান কখনও এক নয়।

শাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র। কিন্তু অর্থবিহীন ও নামে-বেনামে অসংখ্য সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রাম খোলার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন কোর্সের রমরমা বাণিজ্য চলছে। সাধারণ কোর্সগুলো সেশনজটের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও শুধু মোটা অঙ্কের অর্থের লোভে শিক্ষকরা এই শিক্ষা বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স এখনও চালু হয়নি, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর জন্য তোড়জোড়ের খবর পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়।

একটু পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই অনুধাবন করা যাবে যে এই সোনার হরিণের প্রতি শিক্ষকরা কেন এত আগ্রহী! বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হওয়ার পর এই খাত থেকে অর্জিত অর্থের ৬০ শতাংশই পান সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। এই অর্থ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিয়মিত বেতনের দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সান্ধ্যকালীন ক্লাস নেয়া বাবদ প্রতি মাসে সম্মানী পান কমপক্ষে ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। একজন সহযোগী অধ্যাপক পান ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। একজন সহকারী অধ্যাপক পান ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। একজন লেকচারা পান নূন্যতম ৮০ হাজার টাকা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পায় ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ, ৩ শতাংশ পায় ডিন অফিস আর বাকি ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট বিভাগ পায়। এটি সম্পূর্ণ যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের পকেটে। যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স চালু আছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ-বাটোয়ারা প্রায় একই রকম।

একজন ছাত্রকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করে আদর্শ চরিত্রবান মানুষরূপে গড়ে দেশসেবায় নিয়োজিত করতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সেই কারিগরদের নৈতিকতায় যদি কালিমা লেগে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের কি হবে সেটি প্রশ্ন থেকেই যায়। নামমাত্র ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তি শিক্ষার্থী এবং দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মতের বিরুদ্ধে মানহীন অবান্তর সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রাখা দেশের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে তা আজ বড় কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059628486633301