শিক্ষার্থীরা, তোমরা ফাঁদে পা দিও না - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীরা, তোমরা ফাঁদে পা দিও না

মমতাজ লতিফ |

তোমরা কি জান, তোমরা তোমাদের নিজে কতটা অপমান করেছ? কতটা নিচে নামিয়েছ নিজেদের? তোমাদের এই মানসিকতা ছোট-বড়, সমবয়সী সৎ ও সত্য পথে চলতে স্থির প্রতিজ্ঞ, দৃঢ় বিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের কাছে কতটা ঘৃণ্য করে তুলেছে! কেউ কেউ বলছে, ওরা হাতের কাছে পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে, ওদের মা, বাবা, শিক্ষক ওদের প্রশ্ন, উত্তর পরীক্ষার আগে হাতে তুলে দিচ্ছে, ওরা কি করবে, নিয়ে নিচ্ছে! এ মতের আমি, আমরা কঠোরভাবে বিরোধী। এ মতাবলম্বীদের প্রত্যাখ্যান করি।

আমার বক্তব্য, তোমরা শিশু নও, এসএসসি, এইচএসসি এমন কি ক্লাস এইট পাস করার বয়সে তোমরা শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে খুব ভালভাবে অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান সঞ্চয় করে ফেলেছ। আমরাও একদিন তোমাদের বয়সী ছিলাম। সে জন্য, তোমরা ১০-১২ বছর বয়সে ওপরে বলা দুনিয়ার ভাল-মন্দ বুঝেছ, আমরাও বুঝতাম। পৃথিবীর পথে অর্থাৎ যাত্রা পথে, বড় হওয়ার পথে আমাদের পাঠ্যবই, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষা, বাড়িতে মা, বাবার দেয়া শিক্ষা আমাদের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় কাজ চেনায় যাতে আমরা মন্দ, অন্যায়, অশুভ কাজকে প্রত্যাখ্যান করে ভাল, ন্যায়, শুভ কাজকে গ্রহণ করে বড় হয়ে উঠি। পৃথিবীতে চলার পথে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, দু’রকম জিনিসই থাকবে, এর থেকে আমরা, একাই কিন্তু বেছে নেব ভালকে, প্রত্যাখ্যান করব মন্দকে, দৃঢ়চিত্তে দাঁড়াব ন্যায়ের পক্ষে, লড়াই করে সরিয়ে দেব অন্যায়কে। এটাই মানুষের বড় হওয়ার পথ। এটা আগেও সঠিক ছিল, এখনও সঠিক, যুগ পাল্টালেও মন্দ, অশুভ, অন্যায় পাল্টে যায় না। এ কথা তোমরা জান।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়- শয়তান ভাল মানুষ সেজে আমাদের মন্দ কাজে জড়িয়ে ফেলে। তার মানে কি? তার মানে হচ্ছে- ওপরে দেখতে মন্দ নয় মনে হলেও এর ভেতরে মন্দ লুকিয়ে থাকতে পারে যে আমাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সব মানুষের মতো আমাদের সবার ভেতরে ন্যায়, ভাল, শুভ, সত্য-এর প্রতি নিবেদিত যে মন থাকে, সেটির ডাক হৃদয়ের ভেতর থেকে আমাদের বলে দেয়- ‘ভালর পথে থাক, মন্দ কাজটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, ওদিকে দৃষ্টিপাত কর না, মন্দ পথে পা দিয়ে শয়তানের ফাঁদে পা দিও না’। আগেও বলত, এখনও বলে।

শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা, তোমরা বুকে হাত রেখে বল, নিজেকে নিজেই বল- যখন ফেসবুক বা কোন এ্যাপে তোমরা প্রশ্ন পাওয়ার প্রলোভন দেখেছ অথবা যখন তোমাদের কোন কোচিং শিক্ষক, স্কুলশিক্ষক বা এমন কি বাবা, মা প্রশ্নগুলো তোমাকে দিতে আসেÑ তখন, ঠিক তক্ষুণি তোমাদের মনের ভেতরে স্থির হয়ে বসে থাকা বিবেক, শুভবোধ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছে ‘এটা অন্যায়, এটা ফাঁকি দিয়ে পাস করা, এটা খুব মন্দ পথ, এ মন্দ কাজ আমি করতে পারি না, মন্দ আমি হতে পারব না কিছুতেই।’

আমি নিশ্চিত, তোমাদের মন ‘না, না’ চিৎকার করেছে। তোমাদের মনই তোমাদের শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দিতে নিষেধ করেছে। তাই নয় কি? জানত, আমরা প্রত্যেকে মানুষ তো, তাই আমাদের সবার মনের ভেতর এই শুভ-অশুভকে চেনাতে, অশুভ থেকে দূরে সরে যেতে নির্দেশ দেয়ার জন্য ‘বিবেক’ নামে এক বোধ আছে। এমন কি বাবা, মার, শিক্ষকের অনেক মন্দ কাজ নিষেধ করতে আমাদের মনের ভেতর থেকে বাধা দেয় এই বিবেক। কেন কোন এক শিশু মা-বাবার হাতে গৃহকর্মীকে নির্যাতিত হতে দেখলে ভীষণভাবে মা-বাবার ওপর ক্রুদ্ধ হয়? কেন শিশুরা তাদের ডিম, দুধ খেতে দিলে তারা তার খেলার সাথী শিশু গৃহকর্মীকে একই খাবার দিতে জেদ ধরে, কান্নাকাটি করে? বাবা-মা যখন শিশুর বয়স কমিয়ে বলে, তখন কেন প্রায় সব শিশুই তার প্রতিবাদ করে নিজের আসল বয়স বলে দেয়? কেন সব শিশুই মা-বাবা, বড়দের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে?

আসলে, আমরা বড় হয়ে ভুলে যাই যে, শিশুদের মনে থাকা বিবেকবোধ অনেক বেশি বিশুদ্ধ থাকে। সে জন্য তারা সব অন্যায়েরই প্রতিবাদ করে। তারপর তারাই যত বড় হতে থাকে, ততই নানা রকম অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে থাকে, অনেক অন্যায় বিনা প্রতিবাদে হজম করতে থাকে, তারপর একদিন অনেক রকম অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করতে করতে নিজেরাও অন্যায় করতে শুরু করে। বাবা-মা, শিক্ষক, এরা সবাই বয়স্ক, অনেক রকম অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে চলতে কিছু অন্যায়কে তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেন। যেমন, প্রশ্ন ফাঁস। প্রথমে এটি কোন শিক্ষক করেন, নিজের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ভাল ফল করানোর অপরাধমূলক লোভের কাছে হার মেনে এটি করেন। তারপর, এটি বর্তমানে প্রচারিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে- ফেসবুক, টুইটার, মোবাইলে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি প্রশ্ন ফাঁস করল কিন্তু সেটি প্রচার পেত না যদি না ফেসবুক ইত্যাদি প্রযুক্তিজাত যোগাযোগ মাধ্যমগুলো না থাকত অথবা এগুলোকে পরীক্ষার আগের রাত থেকে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা পর পর্যন্ত বন্ধ রাখা যেত। কয়েকজন ব্যক্তি প্রশ্ন ফাঁস করলেও সেটি প্রযুক্তির দ্বারা প্রচার পাওয়ার কারণে বাবা, মা ও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে প্রশ্ন জেনে প্রস্তুতি নেয়ার চরম অন্যায় কাজটি করতে পারছে সহজে। শুধু ব্যক্তি প্রশ্ন ফাঁস করে না হয় তার পরিচিত ক’জনকে এ প্রশ্ন দিত, সেটা হাজার হাজার মানুষের কাছে যেত না।

এখানে দুটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেই। প্রথমটি, ২০০৯ সালের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের খরব টিভিতে কিছুক্ষণ দেখানোর পর দেখা গেল এদের দেখাদেখি অন্য জেলার বিডিআর ক্যাম্পে একই রকম বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে। তখন সরকার টিভিতে এই বিদ্রোহ সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেয় যা সত্যিই এ বিদ্রোহের বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। অপরদিকে, পিলখানার বিদ্রোহীরাও অন্য বিডিআর ক্যাম্পের তথ্য পাচ্ছিল না, অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করতে তারা সম্মত হয়। জাতি হাফ ছেড়ে বাঁচে। একইভাবে, প্রশ্নপত্র প্রচার না হতে দিলে তো শিক্ষার্থী, বাবা, মা প্রশ্নগুলো পেত না।

তবে, আমার শুরুর কথা ছিলÑ শিক্ষার্থীরা কেন এই অন্যায়, মন্দ কাজটি করতে চাইল? মনে পড়ছে, ছোটবেলায় যদি আমরা কোন বিষয়ে পরীক্ষায় নম্বর কম পেতাম, তাহলে মা যখন জিজ্ঞেস করত কেন কম নম্বর হলো, আমরা উত্তর দিতাম, অমুকও তো আমার সমান বা আমার চেয়েও কম নম্বর পেয়েছে, এটি বললে, মা কান ধরে বলত, অমুক যদি গোবর খায়, চুরি করে, তাহলে কি তুইও গোবর খাবি? চুরি করবি? সত্যি বলতে কি, এ দুটোই আমাদের জন্য অসম্ভব কাজ ছিল। সুতরাং আমরা অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে অনভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাতে সুবিধা হয়েছে, কে ফার্স্ট ডিভিশন পেল, তাতে আমাদের মাথাব্যথা হতো না, নিজের উচ্চ দ্বিতীয় শ্রেণী এবং দিন রাত খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া, পাহাড়ে, মাঠে, জঙ্গলে দৌড়ানো, বেড়ানো, স্কুলে অভিনয়, ফাংশন- আর কি চাই- এসবে ডুবে থাকতাম। এত খুশি থাকার জন্য যথেষ্ট।

একটা কথা বলব, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরে আমরা ভাই-বোন উত্তর লিখতাম নিজের ভাষায়, বাংলা ও ইংরেজী- দুটোতেই। গণিতে সে সুযোগ ছিল না, কেউ অঙ্ক বোঝায়নি, গণিতে ছিলাম কাঁচা, পাস নম্বরই যথেষ্ট ছিল। তাই বলে, কারও খাতা দেখে লিখব, এ কথা আমাদের যুগে ছিল অসম্ভব। দু’চারজন যারা নকল করত- তারা ছিল ক্লাসের দুর্বল ছাত্রী, ওদের আমরা করুণার চোখে দেখতাম। তাদের কেউ সম্মানের চোখে কোন দিন দেখবে, তা তারাও ভাবেনি। ওদের কপালে কিন্তু নকল করা ছাত্রীর স্থায়ী এবং অমর্যাদাকর ছাপ পড়ে গেছে যা কোন দিন মুছবার নয়।

বর্তমানে যারা তোমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নগুলো গ্রহণ করে পরীক্ষা দিয়েছ- তাদের এ ব্যাচের প্রকৃত পরীক্ষার্থীরা চিরকাল হেয় চোখেই দেখবে, এত অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি জানি, যারা নকল করে পরীক্ষায় হয়ত ভাল গ্রেড পেয়েছে, তারা উচ্চ শিক্ষার প্রাবেশিকা পরীক্ষায় হয় ব্যর্থ হবে, নতুবা প্রকৃত পরীক্ষার্থীর চাইতে অনেক নিচে নম্বর পাবে। বুয়েটে, মেডিক্যালে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত ভাল ছাত্রছাত্রীরাই পাস করবে এবং শ্রেণীতেও তারাই ভাল ফল করবে।

আরেকটি কথা- ফাঁস করা প্রশ্ন গ্রহণকারীরা কি নিজেদের বিবেকের কাছে দোষী হওনি? নিজেদের আত্মসম্মান নিজেরাই কি বিনষ্ট করনি? নিজেরা নিজেদের কাছে, বন্ধুদের কাছে, সহপাঠী নকল গ্রহণ না করা প্রকৃত শিক্ষার্থীদের কাছে, আত্মীয়স্বজনের কাছে ছোট হয়ে যাওনি? এই ঘৃণ্য অপরাধ করার এ গ্লানি সারাজীবন ধরে কিন্তু বইতে হবে, কেননা সব মানুষের মনের ভেতরে যে বিবেক আছে, সে শান্তি দেবে না কোন অপরাধীকে।

সবশেষে, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীকে বলব, ব্যক্তি প্রশ্ন ফাঁস করে কিন্তু লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীর কাছে তো সেটা ফেসবুক বন্ধ থাকলে পৌঁছাত না, প্রশ্ন বিক্রেতা তার প্রশ্ন বিক্রি করতে পারত না। সরকারকে বলব, কয়েকজন মা পঞ্চম এবং এইটের পাবলিক পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ের খরচের কথা এবং এই দুই পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে বলেও জানিয়েছেন। আসলে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিশু ক, খ, গ, ঘ, ঙ গ্রেড পেয়ে পাস করে যাবে- এ নিয়মই সব দেশে চলছে। এরপর মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে স্কুল সার্টিফিকেট সবাই পাবে। গ্রেড নম্বর দিয়ে তারা উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষায় যাবে অথবা যাবে না, কর্মজগতে প্রবেশ করবে।

ক’দিন আগে খবরে দেখলাম কোন একজন শিক্ষা কর্মকর্তা প্রশ্ন ফাঁস রোধের একটি প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলছেন, প্রত্যেক বিষয়ের একটি প্রশ্নবই হবে যাতে ১০০টি প্রশ্নসেট থাকবে। বইগুলো শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে প্রবেশ করবে, শিক্ষক পাঁচ মিনিট আগে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ১নং, ২নং বা ১০নং প্রশ্নসেটে পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেবে। সম্ভবত ১০টি প্রশ্নসেট থাকলেই যথেষ্ট হবে। তাছাড়া সব বোর্ডে একই প্রশ্নসেট না দিয়ে আলাদা সেট দেয়া যায়। ভাল প্রস্তাবটিকে উন্নত করা যায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

 

সৌজন্যে: জনকণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045108795166016