মানব জন্ম বৃথাও নয় অলীকও নয় বরং অর্থবহ, তাৎপর্যপূর্ণ এবং সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। একটি সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে এটি ভূমিকা পালন করে। জীবনে মূল্যবোধ থাকলেই আমরা প্রকৃত মানুষ বা মহৎ প্রাণী, মূল্যবোধ ছাড়া আকৃতিতে আমরা মানুষ হলেও জন্তুর মতোই প্রাণী। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককেই এ দুনিয়াতে মানব সেবা বা সভ্যতার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য প্রেরণ করেছেন। আমাদের এখন ভাবতে হবে আমরা কীভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারব। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-
বল না কাতর স্বরে
বৃথা জন্ম এ সংসারে
এ জীবন নিশার স্বপন।
মূল্যবোধ শিক্ষা নাগরিকের মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে, যা সুশাসনের পথকে সুগম করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। তাই এটি ব্যক্তি জীবনের গাইডলাইন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্রদের জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব মূলত সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবক এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের। মূল্যবোধ গঠনের অন্যতম মাধ্যম হলো পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, খেলার সাথী, সমাজ ও প্রথা। ছাত্রদেরকে তাদের কর্তব্য ও দায়িত্বজ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন করার মাঝেই জীবনের মূল্যবোধ নিহিত। তাদের ভিতর মূল্যবোধের বীজ বপন করতে পারলে তারা হবে তৎপর, সচেষ্ট; তাতে জীবন হবে উর্বর ও সফল, না হলে তাদের জীবন হবে শূন্য মরুময়। মানুষ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ প্রাণী বিধায় অন্যান্য নির্বাক জীবজন্তু ও প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে এবং তাদের ব্যবহার করে জীবনমানের উন্নতি ঘটাচ্ছে। তাই মানুষের জীবনে মূল্যবোধ থাকা বিধেয়। শিক্ষক ও অভিভাবকের অবর্তমানে লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করে উপলব্ধির ক্ষেত্রকে সম্প্রসারণ করা যায়।
গণতান্ত্রিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, পেশাগত, নৈতিক, বুদ্ধিভিত্তিক, ব্যক্তিগত, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ একটি রাষ্ট্র বা সমাজকে স্থিতিশীল উন্নয়নে সহায়তা করে। যদিও স্থান-কাল-পাত্রভেদে মূল্যবোধের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। আবার একই সমাজে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ দেখা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের ও সমাজের জীবনমানের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। পিতামাতার আদেশ ও নির্দেশ পালন, পোষাক-পরিচ্ছেদ, শৃঙ্খলাবোধ, শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য ধর্ম পালনে বাধা না দেয়া, নিজ ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ না ভাবা, বড়দের সম্মান করা, সহনশীলতা, দানশীলতা, আতিথেয়তা, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচারবোধ, সততা, সরলতা, আনুগত্য, নিজের ব্রত রক্ষা ও লেখাপড়া করা, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, জাতীয় ইস্যুতে সাড়া দেয়া, দেশপ্রেম, মানবসেবা যথা-আর্তির দুঃখ মোচন, পথের কণ্টক অপসারণ, মানুষের দুঃখ কষ্টে সামিল হওয়া, কোনো স্থানে আগুন লাগলে তা নির্বাপনে এগিয়ে যাওয়া এবং কোনো কাজের দায়িত্ব নিলে তা অকপটে ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা-এসবই মূল্যবোধের অংশ। ছাত্রজীবনই মূল্যবোধ বিষয়ক ধারণা অর্জনের উৎকৃষ্ট সময়। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, শাসকগোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগই সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে। ব্যক্তির মূল্যবোধের উপরই নির্ভর করে জাতীয় মূল্যবোধ, জাতীয় শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা। অমূল্য জীবনে মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে হলে নিম্মবর্ণিত পংক্তিটি অনুসরণ করা যায়-
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃ স্মরণীয়,
সেপথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে
আমরা হবো হে বরণীয়।
লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)।