উৎসবের রঙ সবসময়ই আলোকিত করে পরিপার্শ্ব। নতুন বই হাতে উচ্ছ্বসিত শিশু-কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা। নতুন বছর, নতুন শ্রেণি, নতুন বই। ১ জানুয়ারি সারাদেশে ফুটে ওঠে এক অন্যরকম চিত্র। এই চিত্র বড় আশা-জাগানিয়া। ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের এই উচ্ছ্বাস আলোকিত আগামীর বার্তা বহন করে। এরপরও ১ জানুয়ারির সকালটা ছিল অন্যরকম। গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদে প্রতিফলিত হয়েছে এই বর্ণচ্ছটা চিত্র। খুদে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি ছিল না। প্রত্যেকের চোখে-মুখে দেখা গেছে খুশির ঝিলিক। তার কারণ একটাই- নতুন বই। খালি হাতে স্কুলে এসে ঘরে ফিরে গেল নতুন বই নিয়ে। কোথাও মাঠে, কোথাও ক্লাসরুম সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হলো।
গণমাধ্যমে প্রকাশ, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৬ হাজার ৮৯৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ বই ছাপা ও স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রায় ১ লাখ জনবল কাজ করেছে। আরও জানা গেছে, মোট বইয়ের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের ১ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৪০৫টি বই বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রাক-প্রাথমিকের ৩৪ লাখ ১১ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬৮ লাখ ২৩ হাজার ৬০টি বই ছাপা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫৮ হাজার ২৫৫ শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি ভাষায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৭টি বই ছাপা হয়েছে। এ ছাড়াও ৯৬৩ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হবে। উপস্থাপিত এই তথ্য কিংবা সংখ্যাচিত্র স্পষ্টতই বলে দেয়, এটি কত বড় কর্মযজ্ঞ। এত বড় কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করাও সহজ কথা নয়। এ ছাড়া এমন বিশাল কর্মযজ্ঞে কিছুটা ভুল-ত্রুটি কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে অসাবধানতার কারণে। তাই এসব বিষয়কে বড় করে না দেখে, সমালোচনার তীরে বিদ্ধ না করে বরং শুধরানোর প্রচেষ্টা চালানোই শ্রেয়।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। এ পর্যন্ত এই কর্মসূচি বলা যায় সফলভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও বলা দরকার যে, বর্তমান সরকারের এ এক বড় সাফল্য। টানা দুই মেয়াদে এই সরকার রীতিমতো যে একটি বিপ্লব এ ক্ষেত্রে ঘটিয়ে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিনামূল্যের বই, বিশেষ করে মফস্বলের অভিভাবকদের জন্য অবশ্যই বড় স্বস্তির বিষয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহায়তায় নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের কষ্টের বোঝা যে অনেকটাই লাঘব করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া এই কার্যক্রম খুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ভিন্ন রকমের অনুপ্রেরণাও জোগাচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে। ঝরে পড়া প্রাথমিকসহ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সমস্যার যদি সমাধান করা যায়, তাহলে এ দেশের নতুন প্রজন্মের শিক্ষার ভিতটি আরও শক্তভাবে গড়ে উঠতে পারবে এবং দেশ-জাতির জন্য অবশ্যই তা হবে খুব বড় ধরনের ইতিবাচক বিষয়। অনস্বীকার্য যে, শিক্ষার হার ক্রমেই বাড়ছে; কিন্তু শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন কতটা হচ্ছে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরীক্ষার ফলের হার যদি উচ্চ হয়, তাহলে এটিকে কোনোভাবেই শিক্ষার মানের নির্দেশক বলা যাবে না। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে অবশ্যই আরও মনোযোগী হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে শিক্ষা গবেষক, শিক্ষাবিদদের নিয়ে নতুন করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ধরনের সমস্যা-সংকট সৃষ্টি করেছে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি। প্রশ্ন ফাঁস ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। খুব উদ্বেগের কারণ যে, প্রাইমারি স্তরের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসও হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ আলোচনা-পর্যালোচনা এবং প্রতিকারের দিকনির্দেশনামূলক অনেক কিছু উপস্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকার ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বটে; কিন্তু খুবই দুশ্চিন্তার কারণ হলো, এরপরও এই ব্যাধি সারানো যাচ্ছে না। এ কথা সত্য যে, ব্যাধি যেহেতু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, টুটকা দাওয়াইয়ে এর সুফল মিলবে না। এ জন্য উৎসে হাত দিতে হবে, সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে এবং যে মহলের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, একেবারে নির্মোহ অবস্থান থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে উৎস সন্ধান করতে হবে। এই ব্যাধি শিক্ষার মানের সবচেয়ে বড় ক্ষতির পাশাপাশি দেশ-জাতির জন্য নানারকম সর্বনাশ ডেকে আনছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের যে সাফল্য রয়েছে এই সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ করছে এ ধরনের অপকর্ম। শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হলে এই সর্বনাশা ব্যাধির দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা দরকার। শুধু মানের বিষয়টি তো নয়, প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়ার এই অপক্রিয়ার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের অনেক অর্জনের বিসর্জন ঘটবে। শুধু শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, শিক্ষার মান বাড়াতে এবং সব ধরনের অপকর্ম ঠেকাতে সবাইকে কাজ করতে হবে একযোগে।
শিক্ষা তো কোনো পণ্য নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। এর সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সংখ্যা অগণ্য নয়, আমি মনে করি নগণ্য। এই নগণ্য সংখ্যককে কি প্রতিহত করার কোনো উপায় নেই? এর উত্তর যদি হয় ‘না’ সূচক, তবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-হতাশাই বাড়বে। কেন ‘না’ সূচক হবে! সরকার ও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে সজাগ হলে এরও সুরাহা করা দুরূহ কোনো বিষয় নয় বলেই মনে করি। চাই শুধু সদিচ্ছা, যথাযথ কর্মপরিকল্পনা এবং এসবের যথাযথ বাস্তবায়ন। দেশে প্রায় সবক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। বাজারে সিন্ডিকেট, ঠিকাদারিতে সিন্ডিকেট ইত্যাদি কত ক্ষেত্রে। এই সিন্ডিকেট ভাঙার কাজটিও করতে হবে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে বহুবিধ দুস্কর্মের পথ এমনিতেই রুদ্ধ হয়ে পড়বে।
জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সময় প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ এর জন্য যেমন পর্যাপ্ত অর্থ দরকার, তেমনি দরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপযুক্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ, তাদের মর্যাদা, সর্বোপরি যথাযথ পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম। পত্রিকায় দেখলাম এবার প্রাথমিকের ফল হাতে পেয়ে প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিবিড় তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন। অনস্বীকার্য যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের অবহেলা ও ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং তাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার দিকে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষার মান বাড়ানোর কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় এ বিষয়গুলোও আমলে নিয়ে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একটির সঙ্গে আরেকটি বিষয় সম্পৃক্ত। কাজেই একদিকে ঘাটতি রেখে অন্যদিকে সুফল আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
শুরু করেছিলাম বই উৎসবের প্রসঙ্গ দিয়ে। শেষও করতে চাই তা দিয়েই। খুদে শিক্ষার্থীরা ছাপার কাগজের ফর্মার হিসাব বুঝে না। কিন্তু নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা তারা হয় নানা রকম স্বপ্ন পুঁজি করে। তাদের এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটানোর দায়দায়িত্ব যাদের তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ হন, তাহলে সুফলের ক্ষেত্রটা আরও বিস্তৃত হবে। শিক্ষার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে আরও দ্রুতগতিতে আমাদের হাঁটতে হবে। নতুন স্বপ্ন, নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে। আশান্বিত হতে হয়, এখন গ্রামের শিক্ষাচিত্রও অনেক বেশি আশা-জাগানিয়া। দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা লাভে গ্রামের প্রচুর ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হচ্ছে। প্রাথমিক বাতিঘর জ্বালিয়ে রাখছেন লাখ লাখ শিক্ষক। তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে আরও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আর খুদে শিক্ষার্থীদের শুধু পড়ালেখাই নয়, খেলাধুলাসহ বিনোদনের সব মাধ্যম তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই তাদের বিকাশ ঘটবে পূর্ণমাত্রায়। এই জরুরি বিষয়গুলো ভুলে গেলে চলবে না। শিল্প-সাহিত্য খেলাধুলায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের এই লক্ষ্য সব সময় শানিত থাকতে হবে যে, শিশুকাল থেকেই নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে যেন শিশুরা গড়ে উঠতে পারে। সুবিধাবঞ্চিতদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এদেরকে বর্জন করে বা হিসাবের বাইরে রেখে বড় অর্জন সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার দীক্ষা এবং শিক্ষাদানে দায়িত্বশীলদের আরও মনোযোগী হওয়া চাই।
সৌজন্যে: সমকাল