ইত্তেফাকে গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা’ শীর্ষক লেখাটি বোধকরি ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক দুরারোগ্য ব্যাধিতে শিক্ষা কার্যক্রম আক্রান্ত হওয়ার কারণ নির্ণয়ে প্যাথলজিক্যাল কিংবা বায়োকেমিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট। এটি শুধু একটি স্কুলের সমস্যা ভাবলে ভুল হবে। এ সমস্যা দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। যেমন এতদ্সংক্রান্ত দৈনিক ইত্তেফাকের ২০.৮.২০১১ তারিখে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পকেট কমিটি আদালতে মামলা’, ১৮.১০.২০১১ তারিখে ‘রাজীবপুরে কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন পণ্ড’ কিংবা ৬.৪.২০১৮ তারিখে ‘কলেজ সভাপতির বিরুদ্ধে ২৭ শিক্ষকের অভিযোগ’ শীর্ষক সংবাদের কথা বলা যায়। শেষোক্ত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুমিল্লার একটি কলেজের সভাপতি কোনো কারণ দর্শানো কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। এ কারণে অধ্যক্ষসহ ২৭ জন শিক্ষক সভাপতির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থী ভর্তি, ফরম পূরণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের নামে কলেজের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
মূলত বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্কুলের ক্ষেত্রে ১২ সদস্য বিশিষ্ট ম্যানেজিং কমিটি এবং কলেজের ক্ষেত্রে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বর্ডির বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এমনসব ব্যক্তির আসার সুযোগ রয়েছে যাদের না আছে শিক্ষা, না আছে ভদ্রতাজ্ঞান, না আছে শিক্ষার উন্নয়নে বিশুদ্ধ চিন্তাধারা। ম্যানেজিং কমিটি কিংবা গভর্নিং বর্ডির অভিভাবক, দাতা, হিতৈষী, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদে আসার জন্য কোনো শিক্ষাগত সার্টিফিকেট লাগে না। দাতা এবং হিতৈষী সদস্য পদে আসার জন্য কিছু টাকা প্রতিষ্ঠানকে দান করলেই চলে। ফলে সদস্য হয়ে আসা প্রায় অশিক্ষিত, ক্ষেত্রবিশেষে সমাজবিরোধী এবং এলাকায় টাউট হিসাবে চিহ্নিতদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এদের লেজুড়বৃত্তি করতে করতেই শিক্ষকদের সময় চলে যায়। তাছাড়া এদের সঙ্গে স্কুল-কলেজে কর্মরত উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের একটা মানসিক দূরত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৈরি হয়। আবার ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিংবডি গঠনও একটি জটিল প্রক্রিয়া। কে আসবে, কাকে আনা হবে বা আনতে হবে তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ভীষণ চাপের মুখে থাকতে হয়। কমিটিতে ঢুকতে পারা এবং না পারাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের কারণে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। এর সত্যতা নিরূপণে দৈনিক ইত্তেফাকে বিগত ১৪ জুন ২০১৫ তারিখে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়’র শুরুটা এভাবে—‘শিক্ষাখাতের নানান সংকটের মধ্যে ইত্তেফাকে সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে যে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বেশ কিছু এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানগুলির গভর্নিংবডির সহিত যুক্ত রাজনীতিবিদদের অনৈতিক কার্যক্রমে শিক্ষা উন্নয়ন ব্যাহত হইতেছে...।’
এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটি কিংবা গভর্নিংবডির প্রয়োজন আছে কি না তা ভাবতে হবে। প্রসঙ্গত, যখন প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং শিক্ষকদের বেতনভাতা জনে জনে চাঁদা তুলে দিতে হতো তখন কমিটির প্রয়োজন ছিল। এখন বেতনভাতার প্রায় পুরোটাই সরকার বহন করছে এবং স্থাপনা তৈরি বা মেরামতে সরকারি বরাদ্দ জুটছে তাহলে কমিটির প্রয়োজন কোথায়? আবার জবাবদিহিতার প্রশ্নও যদি আনা হয় তাহলেও বলতে হয় প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষাবোর্ড, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, ব্যানবেইস, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (স্নাতক স্তরের জন্য) কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। প্রকারান্তরে এইসব কর্তৃপক্ষই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রক। এইসব কর্তৃপক্ষের আদেশ, নির্দেশ ও শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি বা স্বীকৃতির নবায়ন হয় না। এমনকী বেতনভাতাদির সরকারি অংশ স্থগিত, কর্তন এবং বাতিল করা হয়।