আমাদের রাষ্ট্রীয় কাজে আমলারা এখন কতটুকু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে থাকেন- সঙ্গত কারণে এটি একটি বড় প্রশ্ন। কেবল আমলাদের কথা বলি কেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যে যেখানে আছে, সেখানেই উদাসীনতা আর অবহেলা দৃশ্যমান। এভাবে দায়িত্বে অবহেলার কারণে দেশ ও জাতি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। যে দল সরকারে থাকে, সে দলের বদনাম হয়। গত দু’তিন মাস আগে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা এমপিওভুক্তি বিষয়ে দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যে সব অসঙ্গতি বেরিয়ে এসেছে, সে সবের দায় দায়িত্ব কে নেবে? এক বছর আগে এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইন আবেদন আহ্বান করা হয়। এক বছর পরে এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। আমরা ভেবেছিলাম, যথাযথ যাচাই বাছাই ও সরেজমিন পরিদর্শন করে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। একমাত্র যোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও পাবার জন্য মনোনীত হবে। অবশেষে প্রায় এক বছর পর আড়াই হাজারের উপরে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য তালিকা প্রকাশিত হলো। এরপর আমরা কী দেখতে পেলাম? কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন না করেও এমপিওর জন্য মনোনীত হয়েছে। পূর্বের এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিওর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকারিকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তালিকায় স্থান পেয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই এমন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ঘর-দোর নেই কিংবা ভাড়া বাড়িতে চলে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছে। কুখ্যাত রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তালিকায় এসেছে। দৈনিক শিক্ষা ডটকমের সাহসী ভূমিকার কারণে আমরা এসব অসঙ্গতি ও অনিয়মের কথা জানতে পেরেছি। সারা দেশের মানুষও জানতে পেরেছে। এখন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এমপিওভুক্তির তালিকা প্রণয়নে ভারি অনিয়ম হয়েছে এবং টাকা পয়সার লেনদেন ঘটেছে। এতে নীতি-নৈতিকতার চরম ব্যত্যয় ঘটেছে বলে সাধারণ জনগণ মনে করলে কারো কিছু করার নেই।
আজকাল অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিক্ষকের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন লক্ষ করা যায়। এ জাতীয় শিক্ষকদের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজ অপমানিত হয়ে থাকেন। নিজের মেয়ের বয়সী ছাত্রীর সাথে শিক্ষকের অনৈতিক সম্পর্ক কিংবা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী যৌন হয়রানির ঘটনা আজ আর নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রকাশনা সংস্থা থেকে উৎকোচ নিয়ে নিম্নমানের নোট-গাইড লাগানোর বদনাম কোনো কোনো শিক্ষক সমিতির এবং কোনো কোনো শিক্ষকের আছে। কোচিং বাণিজ্যের বদনাম সবকিছুর উপরে। নোট গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের কারণে আজকাল লেখাপড়া নির্বাসনে যেতে বসেছে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে যতটুকু মনযোগী থাকেন কোচিং ক্লাসে তারচেয়ে বেশি মনযোগ দিয়ে থাকেন।
সন্ধ্যা হলেই লেখাপড়ায় বসতে হবে এবং রাত দশটা-এগারটা পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করতে হবে- সে বাধ্য-বাধকতার গরজ আজ আর শিক্ষার্থীদের নেই। তারা শিক্ষক কিংবা মা বাবা কাউকেই ভয় করে না। এদের কথা নতুন করে ভাবতে হবে। শিক্ষকের শাসনের অধিকার ফিরিয়ে না দিলে দিনে দিনে তারা আরও অসহায় হয়ে পড়বেন। মা বাবারাও সন্তানকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন। পাশাপাশি আমাদের নতুন প্রজন্ম মাদকাসক্তিতেও ডুবে যাচ্ছে।
যাই হোক, শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আলোকপাত করছিলাম। শিক্ষক হচ্ছেন জাতির মহান কারিগর। এই কারিগরদের কারো কারো নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গোটা জাতির দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল অনেক শিক্ষক আছেন, যারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতির পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিছুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সভাপতির পদের বিনিময়ে উপাচার্য পদ ছেড়ে দেবার অভিপ্রায় জেনে সত্যি বিস্মিত হয়েছি। পৃথিবীর বহু দেশে রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে অনেকে পুনরায় শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ইরাকের একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের কথা জানি, যারা প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষে শিক্ষকতায় ফিরে গিয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা একজন শিক্ষকের মর্যাদা কোনো অংশে কম নয়-তা সাধারণ মানুষও জানে। যদি একজন শিক্ষক তা না বুঝেন, তাহলে তিনি কোনো শিক্ষকই নন।
ইদানিং ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকের শিক্ষকতা করার বিষয়টি সত্যি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে যারা শিক্ষতায় ঢুকেছে, তারা ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন? এ জাতীয় লোকদের গুলি করে কিংবা ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলা উচিত। তা না হলে ভুয়া শিক্ষকে দেশ ভরে যাবে। আমাদের শিক্ষা রসাতলে যেতে সময় লাগবে না। কে একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ভুয়া সনদ নিয়ে চাকরি করছেন শুনে মনটা বিগড়ে যাবার উপক্রম হয়।
আরেকটি বিষয় ইদানিং দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। তা হলো-অনেকের ডাবল চাকরি। এক ব্যক্তি এক সময়ে এক সাথে কীভাবে দু’ জায়গায় চাকরি করেন, সেটি আমাদের বোধগম্য হয় না। শিক্ষকতা পেশায় যারা এ রকম দু’ নম্বরী করে, তাদের কী কোনো নীতি নৈতিকতা নেই? তারা কেমন মানুষ? যারা সার্টিফিকেট জাল করে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয় এবং যারা ডাবল চাকরি করে, তারা উভয়েই সমান অপরাধী। এরা শিক্ষার শত্রু। শিক্ষকতা থেকে এদের ঝেটিয়ে বিদায় না করলে আমাদের শিক্ষার বারোটা বাজতে সময় লাগবে না। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনেকে হয়ত এ রকম দু’ নম্বরী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নেবার উপযুক্ত সময়।
আরেকটি কারণে আজ কয়দিন থেকে মনটা ভালো নেই। বিজয় দিবসের আগের দিন রাজাকারের যে তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে মনটা খারাপ হয়ে আছে। রাজাকারের একটি বিতর্কিত তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এখন একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার প্রয়াস দৃশ্যমান। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তালিকা তারা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। রাজাকারের এ তালিকায় নিবন্ধিত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা নিয়মিত পেয়ে থাকেন, এমন অনেকের নাম ও রাজাকারের তালিকায় উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর আপন ভগ্নিপতি বরিশালের সেরনিয়াবত সাহেবের নামও নাকি রাজাকারের তালিকায়। এই সেরনিয়াবত সাহেব মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন। যে মেয়েটি ‘ক-তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, স-তে সাঈদী তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’ বলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কাঁপিয়ে কুখ্যাত কাদের মোল্লাসহ অন্যদের ফাঁসির রায় কার্যকরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আজ তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাও রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু একজন ভাষা সৈনিক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনিও এই তালিকায় একজন রাজাকার। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মানবতা বিরোধী অপরাধের কারণে যাদের বিচার হয়ে ফাঁসি হয়েছে, তাদের অনেকের নাম এ তালিকায় নেই। চট্টগ্রামের সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, এক কথায় সাকা চৌধুরী নামে পরিচিত, তার নামও নাকি নেই। এই তালিকাটি প্রকাশিত হবার পর সঙ্গত কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করে। নানা স্থানে প্রতিবাদ মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন অনুষ্টিত হয়েছে। সর্বশেষ খবর এই যে, বিতর্কিত এই তালিকাটি অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং আগামী ২৬ মার্চ সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
এই তালিকার ব্যাপারে আমার বক্তব্য এই, তালিকাটি কারা করেছে? এই তালিকাটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। অথবা যারা এই তালিকাটি করেছে, তারা দায়িত্ব পালনে দায়িত্বহীন ছিল বলে এমনটি হয়েছে। এমন দায়িত্বহীন লোক দিয়ে এ রকম একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজ করানো ঠিক হয় নাই। যারা এ রকম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা দরকার। বিতর্কিত তালিকাটি প্রকাশ করায় সরকারের ভারি দুর্ণাম হয়েছে। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর অনেকে পদত্যাগ চেয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয় নাকি বলেছেন, তাতে বিএনপি ও জামাতের কারসাজি আছে। কী আশ্চর্য কথাবার্তা! রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর তৎকালীন জনৈক মন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াতের লোকেরা ধাক্কা মেরে ভবনটি ফেলে দিয়েছে। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনে গাধারও হাসি না পেয়ে পারে না।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সামান্য বিতর্কিত কিছু ঘটলেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেন। আমাদের দেশে কবে এই রেওয়াজটি চালু হবে, আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারে না। আদৌ কোনোদিন কি এ মানসিকতা আমাদের হবে?
নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে চিন্তা আমরা মোটেও করি না। বড়দের মান্য করা আর ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা পরিবার থেকেই শিখেছি। আজ ছোটরা বড়দের মান্যগণ্য করে না। বড়রাও ছোটদের আদর করে কাছে ডাকেন না। এভাবে সমাজ চলতে পারে না। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে ঘটতে আমরা এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে মূল্যবোধের নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আমরা একদিন মানুষ নামের পরিচয়টুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলব। আমাদের জায়গা হবে অমানুষদের কাতারে।
আমাদের আজ দরকার হয়েছে, যে কোনো উপায়ে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা। মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে জাগতিক উন্নতির কোনো দাম নেই। আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে কখনো সত্যিকারের মানুষ হওয়া যায় না। শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত যে কোনো কাজ কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ভুয়া সার্টিফিকেটে যারা শিক্ষকতা করে কিংবা যারা ডাবল চাকরি করে তাদের বিষয়ে কোনো আপোষ নেই। এদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সংশোধিত এমপিও নীতিমালা এবং চাকরি বিধিমালায় শিক্ষকদের নীতি ও নৈতিকতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কেবল ধর্মশিক্ষা বইয়ের নামের সাথে নৈতিক শিক্ষা জুড়ে দিলেই হবে না, নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠুক-সে প্রত্যাশা আমাদের সবার।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।